• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:০১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশে এসেছেন প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে নতুন ধরনের গণহত্যা শিরশ্ছেদ করা হচ্ছে, কেটে ফেলা হয়েছে অনেককে

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর আরও বীভৎস নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের নিবাস সংঘাতময় রাখাইনের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, বহু গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, ‘গণহত্যার নতুন ধরন’ শুরু করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের শিরশ্ছেদ ও কেটে দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হামলা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন ৯০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা সোমবার এ তথ্য জানিয়েছেন। সীমান্তের নোম্যানস ল্যান্ডে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়। খবর বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি ও দ্য গার্ডিয়ানের।

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে সেনাবাহিনী তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে এবং নির্বিচারে হত্যা করছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটে তোলা ছবি এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বলেছে,  মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, ‘স্যাটেলাইটে তোলা নতুন ছবিতে একটি মুসলিম গ্রাম পুরো ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা গেছে। এ থেকে সেখানকার পরিস্থিতি যতটুকু খারাপ বলে প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল তার চেয়েও বেশি শোচনীয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে রয়টার্স বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ান্সে অভিযানের মধ্যে গত এক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্যের ২ হাজার ৬২৫টি বাড়ি জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যাযজ্ঞে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। অবশ্য মিয়ানমারের রাষ্ট্র পরিচালিত পত্রিকা ‘গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার’-এর দাবি, অগ্নিসংযোগের পেছনে রয়েছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএস)। দেশটির সেনাপ্রধান বলেছেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে, তার ভাষায় এটা ‘আনফিনিশড বিজনেস’।

এদিকে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়ার ইয়াংঘি লি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিনি সত্যিই ভয়াবহ। এ ব্যাপারে সুচিকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। লি বলেন, এবারের ধ্বংসযজ্ঞ গত অক্টোবরের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নেতা সুচিকে তার দেশের প্রত্যেককে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে ১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উলে্লখ করা হয়, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দু’জন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা এর কয়েকগুণ। রাখাইনে কোনো বিদেশি সাংবাদিক ও দাতা সংস্থার প্রবেশাধিকার না থাকায় সেখানকার প্রকৃত চিত্র পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চুত পাইন গ্রামের ২৭ বছর বয়সী সুলতান আহমেদ বলেন, ‘অনেক লোকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, অনেককে কেটে ফেলা হয়েছে, পাশের গ্রামের সশস্ত্র লোকেরা যখন শিরশ্ছেদ করছিল তখন আমরা পালিয়েছিলাম।

মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, যাদের একটি বড় অংশ উপকূলের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার কক্সবাজার, পার্বত্য তিন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েও পড়েছেন।

এ বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থানের মাঝেই গত বছরের অক্টোবরে আবার নতুন করে সহিংসতা দেখা দেয় বেৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। তখন আরও প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেন।

এবার ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। অর্থাত্ গত ১১ মাসে বাংলাদেশে প্রায় পেৌনে দুই লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।

সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে তৎপর রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। প্রতিদিনই নেৌকায় বা সীমান্ত পথে আসা রোহিঙ্গা আটক করে পরে তাদের ফের নিজ দেশে পাঠাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় নেৌকাডুবে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

একদিনেই এসেছে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা : বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী এক রাতের ব্যবধানেই টেকনাফে পালিয়ে আসা নতুন ১৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে চিহ্নিত করেছে।

অস্থায়ী আশ্রয়ের জন্য স্কুল-মাদ্রাসাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো এখন উপচে পড়ছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বিবিসিকে বলেছেন, এক রাতের ব্যবধানেই তারা রোববার নতুন অন্তত ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি বলেন, পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির কুতুপালং এবং নয়াপাড়া তাতে আর তিলধারণের জায়গা নেই। স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসা ছাড়াও বিভিন্ন খোলা জায়গায় তঁাবু খাটিয়ে পালিয়ে আসা মানুষজনকে ঠঁাই দেয়ার চষ্টো চলছে।

কিন্তু বর্তমান হারে শরণার্থী আসতে থাকলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। ঈদের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা এখন সম্ভব হলেও, ছুটি শেষে কি হবে তা নিয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, আরও হাজার হাজার লোক বাংলাদেশ সীমান্তের পথে রয়েছেন।

বাংলাদেশে-মিয়ানমার সীমানে্তর নোম্যানস ল্যান্ডের কয়েকটি জায়গায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছেন। রেডক্রস কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ বিবিসিকে বলেন, নোম্যানস ল্যান্ডে বসে থাকা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সঙ্গিন, কারণ তাদের কোনো সাহায্য দেয়া যাচ্ছে না।

সীমানে্তর কাছে বিস্ফোরণ : বাংলাদেশ সীমানে্তর কাছে মিয়ানমারের অংশে সোমবার দুটো বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা গেছে, উড়তে দেখা গেছে ঘন-কাল ধোঁয়া।

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা জানিয়েছে, মিয়ানমারের প্রায় ৫০ মিটার ভেতরে ঘটা বিস্ফোরণে এক নারীর পা উড়ে গেছে। তাকে চিকিত্সার জন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে। সামবার মিয়ানমারের তাউং পায়ো গ্রামের কাছে বিস্ফোরণের আগে গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া এবং আগুন দেখতে পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারা। সীমান্তরক্ষীদের ধারণা, আহত নারী পাতা মাইনের ওপর পা দিয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

রাখাইনে জাতিসংঘের ত্রাণ তত্পরতা স্থগিত : এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মুখে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচি স্থগিত করেছে জাতিসংঘ।

২০১২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে আড়াই লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতো। কিন্তু এ কর্মসূচি স্থগিত করায় তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হল।

শনিবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন দুই লাখ ৫০ হাজার এবং অন্যান্য অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে যে খাবার সাহায্য দেয়া হতো, তা স্থগিত করা হল।

এদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ডব্লিউএফপির খাবারের ওপরই নির্ভর করত। এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। যারা জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, তাদের অবস্থাও করুণ।

অনেককে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মাথাগোঁজার ঠাঁই করতে উপকূলের পাশে বন-জঙ্গল সাফ করেবাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি তৈরির চষ্টো করছে।

জাতিসংঘ ছাড়াও আরও ১৬টি মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ত্রাণ কার্যক্রমে অসহযোগিতা আর বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে।

দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কখনও ভিসা বন্ধ করে, কখনও সহায়তাকর্মীদের ফেরত পাঠিয়ে, কখনও বা স্থানীয় প্রশাসনের রক্তচক্ষুর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয়া হচ্ছে।

অভিযান শুরুর পর বেসামরিকদের বিপন্নতার মধ্যেই ২ সেপ্টেম্বর রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করার ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। নিরাপত্তাজনিত সংকটকে কারণ দেখিয়ে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।

তবে মিয়ানমারের জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয় গার্ডিয়ানকে ইঙ্গিত দিয়েছে, মিয়ানমার সরকারই তাদের কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না।

জাতিসংঘ ছাড়াও অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিশ্বের বড় বড় ১৬টি মানবিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানও অভিযোগ করেছে মিয়ানমার সরকার তাদের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যেতে দিচ্ছে না।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page