• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১৫ অপরাহ্ন

নীলা চৌধুরী সালমান শাহ হত্যার পরিকল্পনা হয় চিটাগাং ক্লাবে

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

“বাংলা সিনেমার ‘স্টাইল আইকন’ খ্যাত এক সময়কার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহকে হত্যার পরিকল্পনা হয় চিটাগাং ক্লাবে। হত্যার ৪ দিন আগে সামিরার (সালমান শাহর স্ত্রী) মায়ের দাওয়াতে চিটাগাং ক্লাবে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও ভারতীয় অভিনেত্রী মুনমুন সেন গ্যাং। সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য সালমানকে প্রস্তাব দেয়া হয়। আর সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ওই ক্লাবে বসেই সালমানকে হত্যার পরিকল্পনা হয়।” মঙ্গলবার দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো বলেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটনে নিজ ফ্ল্যাটে সালমান শাহর
রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দিনটি সামনে রেখেই সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী  সে সময়কার নানা ঘটনা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও মুনমুন সেন তাদের দলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সালমানের সঙ্গে অনেক কথাকাটাকাটি হয়। কিন্তু সালমান তা মানেনি। ২ সেপ্টেম্বর চিটাগাং থেকে ঢাকায় ফেরে সালমান। আর মারা যাওয়ার একদিন আগে সালমান আমাকে বলেছিল, ‘আম্মা ওদের (আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও মুনমুন সেন) সবকিছু (অবৈধ কার্যকলাপ) আমি জেনে এসেছি। আমি বলেছিলাম, এমন খারাপ মানুষদের কাছে যেতে নেই। সব জেনে গেলে ওরাতো (গ্যাং) তোকে মেরে ফেলবে। সালমান বলেছিল- আম্মা, তোমার ছেলের হাতও অনেক লম্বা। ওরা আমাকে কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি আমার ছেলের।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেক প্রচেষ্টার পর ওই ঘটনায় করা মামলাটি এতদূর নিয়ে আসতে পেরেছি। সম্প্রতি মামলায় রুবি নামের এক আসামি ভিডিও বার্তায় সালমান শাহকে যে হত্যা করা হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন। এটা বাস্তব সত্য। তার (রুবির) ভাইয়ের ওপর আঘাত করেছে বলেই সে এখন সত্য বলে দিচ্ছে। সেও আমার ছেলে হত্যায় জড়িত ছিল। হত্যার আলামত সালমানের স্ত্রী সামিরাই ওই রুবির হাত দিয়ে নষ্ট করেছিল।’ সালমান শাহর মা বলেন, “১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট সামিরার একটি নোটবই আমার হাতে আসে। তাতে লেখা ছিল, ‘তুমি আমাকে ডিভোর্স করে পৃথিবীতে থাকবে, না না …’- এ নোটটি সিআইডিকে দিয়েছিলাম। তার কোনো উত্তর পাইনি। পরে ওই নোট বইয়ের আর খোঁজ পাইনি। সামিরার ওই নোট থেকেও সালমানের হত্যার বিষয়টি ধারণা করা যায়। এছাড়া ঘটনার দিন ভোর ৪টা থেকে একটা বেবিট্যাক্সিতে সব মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আর ২ মাস আগেই ঘর থেকে স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়ে গেছে। তখন থেকেই ষড়যন্ত্র চলছিল। ঘরে সামিরার শাড়ি-কাপড় কিছু ছিল না। ভালো একটা বেডশিড পাইনি, ভালো একসেট বাসন পাইনি। আমার ছেলের ঘরে কি কিছুই ছিল না?”

এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এতদিন পর এক নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সালমান শাহ হত্যার বিচার হবে। বিচার এখন দ্বারপ্রান্তে। এখন আসামি (রুবি) নিজেই তা স্বীকার করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় আসামি রুবিকে দেশে এনে সাক্ষী নেয়ার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

ঘটনার ২১ বছর পার হলেও সালমান শাহর মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। কয়েক দফা তদন্তে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তা মেনে নিতে পারেনি সালমান শাহর পরিবার ও ভক্তরা। সর্বশেষ গত বছরের শেষের দিকে পুলিশের নবগঠিত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নতুন করে তদন্ত ভার দেয়া হয়েছে।

তবে দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় এ মামলার অসংখ্য আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে সম্পৃক্তদের অনেকেরই জবানবন্দি নেয়াও সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় অধিকতর তদন্তে কতটুকু অগ্রগতি হবে তা নিয়ে খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্টরাই সন্দিহান। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি সালমান শাহর অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের দাবি জানিয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর এ মামলার অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইর ইন্সপেক্টর সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই মামলার সাক্ষী হিসেবে নতুন করে সালমানের মামা ও মা’র বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া এ মামলার আসামি রুবির দুটি ভিডিও বার্তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তবে দুটি ভিডিও বার্তায় দুই রকম কথা বলেছেন রুবি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অবহিত আছেন। তাদের (ঊর্ধ্বতন) কর্মকর্তাদের অনুমতি পাওয়া গেলে রুবিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নেয়া হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মামলাটি বেশ পুরনো বিধায় এ মামলার নতুন করে কোনো আলামত পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। যেসব আলামত ছিল তাও অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ সাক্ষী ও আসামি বিদেশ থাকায় মামলাটির তদন্ত নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কবে নাগাদ এ তদন্ত শেষ হতে পারে তা বলা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে নীলা চৌধুরীর অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইনজীবীরা সালমান শাহর প্যালেন আইনজীবী হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশের সব বার থেকে আইনজীবী নিয়ে আমরা সালমান শাহ আইনজীবী পরিষদ গঠন করার চেষ্টা করছি। আইনজীবী সমাজ সজাগ হলে এ হত্যার বিচার হবেই। সমাজের সর্বস্তর থেকে সোচ্চার না হলে এ হত্যার বিচারের আলো মাঝে মাঝে জাগ্রত হবে, কিন্তু তা ফের নিভে যাবে।

তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ : মামলার পর দফায় দফায় তদন্ত চলে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। সালমানের মা নীলা চৌধুরীর অভিযোগ, ঘটনাস্থলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এমন অনেকেরই জবানবন্দি নেয়া হয়নি। জব্দ করা হয়নি ফ্যানটিও। তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘুষ খেয়েই এ ধরনের কাজগুলো করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে এটি হত্যা প্রমাণ না হয়।

আলোচিত সেই স্বীকারোক্তি : সালমানের মৃত্যুর ১০ মাস পর তদন্ত এক নাটকীয় মোড় নেয়। সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রিজভি আহমেদ নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে বাসায় অনধিকার প্রবেশের অভিযোগ এনে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রিজভি আহমেদ আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সালমানকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তার দাবি, এ হত্যার পেছনে আছেন সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, তার শাশুড়ি লতিফা হক, চলচ্চিত্রের খল চরিত্রের অভিনেতা ও সালমানের বন্ধু আশরাফুল হক ওরফে ডন ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এদের সঙ্গে তিনি (রিজভি) নিজেও ভাড়াটে খুনি হিসেবে যুক্ত হন। তবে তদন্ত শেষে পুলিশ বলেছে, রিজভির জবানবন্দি মিথ্যা।

বিচার না পেলে আত্মহত্যার হুমকি ভক্তদের : এদিকে রুবির ভিডিও বার্তার সূত্রে খুনিদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠছেন সালমান শাহর ভক্তরা। ওই ভিডিও বার্তা বের হওয়ার পর ইতিমধ্যেই বেশ কয়েজন বিচার না হলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। এ বিষয়ে সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব আসামি রুবিকে দেশে এনে সাক্ষী নেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে- বর্তমানে বাচ্চারা (সালমান শাহর ভক্ত) অনেক ক্রেজি হয়ে গেছে। এর আগেও সারা বিশ্বে ৪১ জন মারা গেছে। এখনও অনেকে আত্মহত্যা করবে বলে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছে। শুধু সালমান শাহর হত্যারই নয়, ওই ৪১ জনসহ আমি মোট ৪২ জন হত্যার বিচার চাই।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সালমান শাহর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সালমান শাহ ঐক্যজোট। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগায় জমায়েত, দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে সালমান শাহের কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মাজার ও কবর জিয়ারত, বাদ জোহর কোর্ট পয়েন্টে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ।

নীলা চৌধুরী
সালমান শাহ হত্যার পরিকল্পনা হয় চিটাগাং ক্লাবে

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page