• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিংয়ের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিশ্বে সবচে নিপীড়িত ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত জাতি হিসেবে বার্মার অধিকারে থাকা আরাকান রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠির নাম অনেক দিন ধরেই নানা ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক শাসনকেই এতদিন সেখানকার রোহিঙ্গাদের অধিকার বঞ্চনার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ধারনা করা হচ্ছিল, গণতন্ত্রপন্থি নেতা অং সান সুচি’র মুক্তি এবং ভোটের মাধ্যমে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাত দশকের বঞ্চনার অবসান ঘটবে। হাজার বছর ধরে আরাকানে বসবাসকারি রোহিঙ্গারাই সেখানকার ভূমিপুত্র। অথচ শুধুমাত্র মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের শাসকরা আরাকান মুসলমানদের বার্মিজ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। শুধুমাত্র নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও অধিকারহীনতার কারনেই বার্মার স্বাধীনতাত্তোর আরাকান রোহিঙ্গারা স্বদেশভ‚মি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়নি। তাদের ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত করার সব ধরনের অপকৌশলই প্রয়োগ করেছে উগ্রপন্থী সহিংস বৌদ্ধ এবং জান্তা সরকারের পেটোয়া বাহিনী। প্রায় তিরিশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের প্রায় অর্ধেক গত ৬ দশকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের নির্মম দাঙ্গা, আধাসামরিক বাহিনীর বেপরোয়া নির্যাতন সহ্য করেও যারা এতদিন পূর্বপুরুষের ভিটামাটি আঁকড়ে ধরে পড়েছিলেন, মিয়ানমার সরকারের এবারের অভিযানটি চালানো হচ্ছে তাদের শুধুৃ উচ্ছেদই নয়, নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে। একবিংশ শতকে এসেও একটি সুসভ্য, অসামরিক জাতিগোষ্ঠিকে এমন নির্মমতার সম্মুখীন হতে হবে, এটা কল্পনাও করা যায়না। পিতামাতার সামনে কন্যাদের উলঙ্গ করে গণধর্ষণ, যুবক সন্তানদের নৃশংস কায়দায় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে, পশুর মত জবাই করে হত্যার সামান্য কিছু দৃশ্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও নজরদারির ফাঁক গলিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বাবা-মা’ কে বেঁধে রেখে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে, নদীতে নিক্ষেপ অথবা মাটিতে আছড়ে মেরে ফেলার মত নির্মমতাও সভ্য দুনিয়ার মানুষ নীরব দর্শক হয়ে প্রত্যক্ষ করছে। প্রাণ বাঁচাতে গত দুই সপ্তাহে নতুন করে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাখাইনে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, জরুরি চিকিৎসা সেবা এবং সব ধরনের গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় সেখানকার প্রকৃত অবস্থার সামগ্রিক চিত্র হুবুহু পাওয়া অসম্ভব। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও ক্লিপিংস এবং স্বজন হারিয়ে আহত, অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বাকরুদ্ধ বোবাকান্না এবং পাগলপ্রায় আর্তনাদের অশ্রুতে কাতর বর্ণনা থেকে সেখানকার অবস্থা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ইতিপূর্বে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশনের অন্তবর্তিকালীণ রিপোর্টেও রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলিকরণের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এখন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণনা এবং বিভিন্ন আন্তজাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আরকানে শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে বিরাণভ‚মিতে পরিণত করা হয়েছে। হাজার হাজার যুবক, শিশু ও নারীকে হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে সুপরিকল্পিতভাবে আরাকান রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্নকরণের বার্মিজ তৎপরতা সম্পর্কে এতদিন বিশ্বসম্প্রদায় তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও এখন অবশ্য রাখাইনে চলমান বার্মিজ সামরিক তৎপরতাকে জেনোসাইড বা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণিত হচ্ছে। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষ বিবদমান সেনাবাহিনীর নির্মমতার শিকার হলেও শান্তির সময়ে একটি অতি অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠির উপর এমন গণহত্যার ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাঙ্গালী মুসলমানদের নিকটম প্রতিবেশী। বিশেষত: বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সাথে ভাষা, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় থাকতে চায়না। প্রথমত: অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও এ দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত: পাশের ঘরে আগুন লাগলে কোন প্রতিবেশী চুপ করে বসে থাকতে পারেনা। প্রতিবেশীর ঘরের আগুন আমার ঘরটিকেও পুড়িয়ে দিতে পারে। এখানে প্রথম মানবিক কাজ হচ্ছে ঘরের মানুষগুলোকে উদ্ধার করা ও আশ্রয় দেয়া, দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে আগুন নেভাতে সহায়তা করা, তৃতীয় কাজ হচ্ছে আগুন লাগার কারণ উদঘাটন করা। তবে রাখাইনে গণহত্যা ও নাশকতার কারণ উদঘাটনে নতুন করে কোন তদন্তের প্রয়োজন নেই। সারাবিশ্বই এখন জেনে গেছে রাখাইনে গণহত্যা ও রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পিত ঘটনা। প্রায় সাড়ে ৬লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বার্মা থেকে ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের আরাকান রাজ্য ১০ হাজার ফুট উঁচু দুর্গম আরাকান পর্বত দ্বারা বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিকভাবে আরাকান কখনো বার্মার অংশ ছিলনা। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে একজন বার্মিজ রাজা কর্তৃক আরাকান দখল হওয়ার আগ পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে আরাকানের উপর বাংলার সুলতানদের নিয়ন্ত্রন ছিল। সে সময় বাংলা এবং আরাকানের সীমারেখা নাফ নদীর এ পার ওপারে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরাকানের স্বীকৃতি অগ্রাহ্য হলে তা’ শুধু বাংলার সাথে যুক্ত হওয়াই ছিল সবদিক থেকে সঙ্গত। বার্মিজ রাজাদের জবর দখলের ধারাবাহিকতায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আরাকানকে বার্মার সাথে সংযুক্ত করে এবং ১৯৩৫সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় আরকানের স্বায়ত্বশাসনের সুযোগ থাকলেও ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার সময় আরাকানকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত করাই আজকের রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎস। একইভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা ও বৈরিতার মূলেও বৃটিশদের ভারত ভাগের ভুল ফর্মূলার খেসারত দিতে হচ্ছে এ অঞ্চলের শতকোটি মানুষকে। দ্বি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের জন্য গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যার স্যার সিরিল রেডক্লিফ কর্তৃক বাংলা, কাশ্মির, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তানের মাঝখানে মনগড়াভাবে পেন্সিলের দাগ কেটে দেশভাগ করার কুফল এখনো বহন করতে হচ্ছে আমাদের। বাংলা বা পাঞ্জাব দ্বিখন্ডিত করার কিছু যুক্তি থাকলেও আরাকানকে বামার্র সাথে যুক্ত করার কোন দূরতম সাংস্কৃতিক বা ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক বা কার্যকারণ ছিলনা।
মূলত: বার্মিজ এবং বৃটিশদের দখলে যাওয়ার পর থেকেই স্বাধীন আরাকানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলীন হতে শুরু করে। তবে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা কখনো তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়নি। জাতিগতভাবে মুসলমান হওয়ার কারণেই পূর্বপাকিস্তানের পাশে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে ভবিষ্যতে হুমকি হিসেবে দেখেছে বার্মিজরা। বার্মিজদের চেতনায় এই ভেদবুদ্ধি ঢুকিয়ে দেয়ার পেছনে বৃটিশ ঔপনিবেশিক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কুশীলবদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থাকতে পারে। সমুদ্রোপকূলবর্তি আরাকান অঞ্চলের ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং সেখানকার মাটির নিচে খনিজ সম্পদের বিশাল সম্ভাবনা থাকার কারণেই এখন রোহিঙ্গা উচ্ছেদ করে সেখানে বহুজাতিক কোম্পানীর কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছে মিয়ানমারের সরকার ও উপ্রপন্থী বৌদ্ধরা। তবে রাখাইনে সাম্প্রতিক গণহত্যা এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে মাস এক্সোডাস বিশ্ব গণমাধ্যমে যে সব শিরোনাম ও বিশ্লেষণ চলছে সেখানে রাখাইন গণহত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিসমুহের স্পষ্ট মদদ থাকার আলামত পাওয়া যায়। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যেসব দেশ প্রতিক্রিয়া বা শীতলতা দেখাচ্ছে, সেখানেই সাম্রাজ্যবাদের কুশীলব ও চলমান বিশ্বরাজনীতির অনুঘটক দেশগুলোর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যায় আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের সমর্থন না থাকলে মুসলিম বিশ্ব, জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের জনমত উপেক্ষা করে নৃসংশতা অব্যাহত রাখার সাহস হতোনা। সউদী আরবসহ জিসিসিভুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিষ্ময়করভাবে নীরব থাকলেও তুরস্ক ও ইরানকে যথেষ্ট সরব দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকেও কিছু তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়েতি বলেছেন, রোহিঙ্গারা ইসরাইলী ষড়যন্ত্রের শিকার। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনীদের নির্মূল করতে অব্যাহত আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে। অবরোধ ও বিমান হামলা করে ফিলিস্তিনি যুবক, নারী ও শিশুদের হত্যা করার প্রতিক্রিয়াকে অন্যত্র সরিয়ে নিতেই তারা মিয়ানমার সরকারের সাথে যোগসাজশ করে রাখাইনে গণহত্যায় মদদ দিচ্ছে। ফিলিস্তিনী নারী ও শিশুদের উপর ইসরাইলী বর্বরতা ঘটনাকে অন্য রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা সংঘটিত আরো নির্মম ঘটনা দিয়ে আড়াল করতেই তারা এটা করছে বলে আলী আকবর বেলায়েতি তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। কিছু দু:খজনক আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বাদ দিলে ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ওআইসি ও বিশ্বনেতারা সকলেই রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের পক্ষে কথা বলছেন। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা যুবকরাও জীবন বাজি রেখে স্বদেশে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেছে। গণহত্যা চালিয়ে যেমন কোন জাতিকে নির্মূল করা কখনো সম্ভব হয়নি, একইভাবে মানবতার স্বপক্ষে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদি লড়াইয়ের মাধ্যমেও জাতিগত সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও ফিলিপিনো মরো মুসলিমদের ইতিহাসই তার বড় প্রমাণ। এসব দেশের দশকের পর দশক ধরে মুক্তিকামি মানুষের রক্ত ঝরলেও সমস্যা সমাধানে বিশ্বশক্তিগুলোর কোন কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় সেখানে শান্তির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। তবে রাখাইনে বার্মিজদের পৈশাচিক বর্বরতা ও গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহুদেশ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি এমন এথনিক ক্লিনজিংয়ের পক্ষে কোন রাষ্ট্রশক্তির প্রকাশ্য সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও ইতিমধ্যে চীন ভেটো দিয়ে জাতিসংঘের একটি যৌথ বিবৃতি ঠেকিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্ধি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও মিয়ানমারের পদক্ষেপ সমর্থন করতে দেখা গেছে। রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। বিনিয়োগের স্বার্থ রক্ষায় যদি চীন মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার ঘটনাকে সমর্থন দেয় সেটা পরাশক্তি হিসেবে তাদের হীনতা ও অযোগ্যতার পরিচায়ক হিসেবেই দেখা হবে। একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক ইসরাইল সফরের মধ্য দিয়ে ভারত-ইসরাইলের নতুন সম্পর্ক আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার যখন রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে তখন ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তির একটি মানবিক অবস্থান গ্রহণের বদলে ভারতে অবস্থানরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে বের করে দেয়ার ঘোষনা দিয়ে অং সান সুকির কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। রোহিঙ্গা গণহত্যায় ইসরাইলের সম্পৃক্ততার অভিযোগ যদি সত্য হয় এবং ইসরাইলের সাথে গোপন সমঝোতার কারণেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের গৃহিত ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। তবে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা রোহিঙ্গা সংকটে ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যা চলমান বিশ্বব্যবস্থা এবং মানব সভ্যতার উপর একটি বড় ধরনের চপেটাঘাত। সভ্য দুনিয়া মুখ বুজে এই চপেটাঘাত সহ্য করবেনা। আরাকান বার্মার অংশ হওয়ার কথা নয়, সামন্তবাদি জবরদখল এবং বৃটিশ ঔপনিবেশিক নীল নকশার কারণেই আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা এখন ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যা ও নির্মূৃিলকরণের শিকার। বিশ্বে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উদ্ভবের বহু আগেই ইসলামের স্বর্ণযুগে একটি খিলাফা রাষ্ট্রব্যবস্থায় একই সাথে বহুমত ও পথের মানুষের সম্মিলন ও বিকাশের পথ সুগম হয়েছিল। এ কারণেই স্পেনের আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় মুসলিম শাসকদের অধীনে থাকা ইহুদিরা তাদের সংস্কৃতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উদ্ভাবনী সৃজনশীলতার মাধ্যমে ইহুদি স্বর্ণযুগের সূচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। যেসব রাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা মাল্টিকালচারালিজম বা বহু মত ও পথের সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ জাতিগত প্রয়াস ছাড়া কোন জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত শাসকরা রাজনীতিতে মাল্টি-কালচারালিজমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বদলে একদেশদর্শী ও বর্ণবাদি চিন্তা ঢুকিয়ে সাম্রাজ্যবাদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন ত্বরান্বিত করছেন। মিয়ানমারের শাসকরা কখনো আরাকানে নিজেদের জিও-পলিটিক্যাল লিগ্যাসি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তারা শুরু থেকেই সেখানকার ভূমিপুত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিধন অথবা উচ্ছেদের পন্থা গ্রহণ করে উগ্রবাদি বৌদ্ধদের জন্য আরাকানের ভূমিকে নিষ্কণ্টক করতে চাইছে। এ সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ৩৬তম অধিবেশনে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার ঘটনাকে ‘টেক্সটবুক কেইস অব এথনিক ক্লিনজিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের ইতিহাসে এ যাবৎ যতগুলো গণহত্যা বা নির্মূলকরণের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর নৃসংশতার ঘটনা তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এ সপ্তাহ আগেও মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা, স্টেট কাউন্সিলর রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্মূল অভিযানের ঘটনাকে অস্বীকার করে বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। এর আগেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বাস্তব অবস্থা এবং করণীয়সমূহ তুলে ধরা হয়েছিল। আর জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল হুসাইনের রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের ক্যাটাগরিক্যাল চিত্র বেরিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের রিপোর্ট রাখাইনের রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনাকে সামনে রেখে ভারতের ভ‚মিকারও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচে আলোচিত ও সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নেটওর্য়াক চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের অন্যতম পশ্চাতভূমি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। বিশেষত: রামরি দ্বীপের অর্থনৈতিক জোন, প্রস্তাবিত কিয়াউকাফিও গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূল থেকে কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস ও জ্বালানী তেলের পাইপলাইনে চীনের হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ রাখাইনের স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করছে। চীনের রোড ইনিশিয়েটিভে ভারত যোগ দেয়নি। সাম্রাজ্যবাদি পশ্চিমা বিশ্ব এই প্রকল্প সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হওয়াও স্বাভাবিক। তবে চীনের সমর্থন বা সবুজ সঙ্কেত ছাড়া রাখাইনে এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের পক্ষে সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোন কোন পশ্চিমা বিশ্লেষক কথিত ভূ-রাজনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থের লড়াইয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদেরকে পণ হিসেবে দেখছেন। একজন পশ্চিমা সমালোচক রাখাইন পরিস্থিতিকে এঙ্গলো- চাইনিজ প্রক্সি ওয়ার হিসেবে বর্ননা করেছেন। সেখানে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির উত্থান অবধারিত ছিল। মানবতাকে পদপৃষ্ঠ করে, ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করে বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থের লড়াই বন্ধে রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক শক্তিসমূহ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। মিয়ানমারের শাসকরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করতে পারবেনা। এটা নিশ্চিত। তাদেরকে রাখাইনে ফিরিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করে উন্নয়ন পরিকল্পনায় কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাখাইনের উন্নয়নে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের অধিকারের স্বীকৃতিই হচ্ছে সংকট নিরসনের একমাত্র পথ। এ প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের সুদূর প্রসারি পরিকল্পনা ও ক্যাম্পেইন বিশ্বসম্প্রদায়ের জোরালো উদ্যোগ নিশ্চিত করতে পারে।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page