স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দেশে শিল্প-কারখানা ও নূতন কর্মক্ষেত্র বহুগুণে বৃদ্ধি পাইলেও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার অগ্রগতি হয় নাই আশানুরূপভাবে। ফলে প্রায়শ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটিতেছে। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের সমপ্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, ২০১২ হইতে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হইয়া চার হাজার ৬১৬ জন শ্রমিক নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যাও চার সহস্রাধিক। অর্থাত্ প্রতি মাসে পেশাগত দুর্ঘটনায় গড়ে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ৭৬ ও আহতের সংখ্যা ৭১ জন। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিশ্চিত করিবার বিষয়টি এখনো যে কতটা অবহেলিত এবং প্রচলিত বিধিবিধানের প্রয়োগ কতটা শিথিল, তাহা এই পরিসংখ্যান হইতেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত প্রায় সকল দেশেই কর্মক্ষেত্রে কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটিয়া থাকে। বাংলাদেশও ইহার ব্যতিক্রম নহে। তবে আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যুর মূলে যেইসব কারণ রহিয়াছে সেইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইল বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়া, অগ্নিকাণ্ড, ভবন হইতে পড়িয়া যাওয়া, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ, দেয়াল-ভবন-ছাদ ও মাটিধস। এই সকল ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়া হইলে বহুলাংশেই শ্রমিকের মৃত্যু ও দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এই সম্পর্কিত বিশ্বস্বীকৃত নীতি হইল ‘সেফটি ফার্স্ট’ বা নিরাপত্তাই প্রথম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় না বলিয়াই হতাহতের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। যেমন, সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা হেলমেট পরেন না। অনেক সময় কর্মস্থলে থাকে না অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও সাজ-সরঞ্জাম। চোখে বিশেষ যন্ত্র না পরিয়াই করা হয় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। কয়েকদিন আগে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হইয়া নরসিংদীতে ছয় জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনসহ মোট ৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হইয়াছে। দুর্ভাগ্যজনক হইলেও সত্য যে, এইখানেও যথেষ্ট সেফটি বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল না। আবার শ্রমিকদের অসচেতনতার কারণেও প্রায়শ তাহারা দুর্ঘটনার শিকার হইতেছেন। তাহাদের জন্য হেলমেটসহ নানা নিরাপত্তামূলক উপকরণ বরাদ্দ করা হইলেও অনেক সময় দেখা যায়, তাহারা এই ব্যাপারে উদাসীন। আবার এইসব বিষয় তদারকির দায়িত্ব যাহাদের, তাহাদের গাফিলতিও উপেক্ষা করিবার মত নহে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহিত কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উন্নয়নকে টেকসই করিবার অন্যতম পূর্বশর্ত। তাই কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো প্রকার শিথিলতা গ্রহণযোগ্য নহে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ, শ্রমিকদের সচেতনতা ও সরকারের নিবিড় নজরদারির মাধ্যমে কর্মস্থলে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করিতে হইবে। সর্বোপরি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শকগণের নিয়মিত শিল্প-কলকারখানা পরিদর্শনসাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি।