• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:১৩ পূর্বাহ্ন

সিদ্ধান্ত হোক যৌথভাবে

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ছোটবেলা থেকে যে খুব স্কুলে যেতাম বা পড়তে চাইতাম সেরকম নয়। সব সময় বাড়ি থেকে যেসব কাজ করতে মানা করা হতো, যেমন দূরে কোথাও একা যাওয়া, গ্রামের পেছনে জঙ্গলে যাওয়া- সেসবই করতে চাইতাম। বাড়ির ছোট সন্তান হওয়ায় একটু চঞ্চল ছিলাম। কিন্তু ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে বাড়িতে আমার বিয়ে নিয়ে কথা শুরু হলো। আমি জানি না কেন যেদিন থেকে বাবা মা আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন, সেদিন থেকে মনে হলো আমার পড়তেই হবে, ভালো করতেই হবে। বলছিলেন সোমা আহমেদ।
এখনো আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামে অনেক নারীর স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতে বিয়ে হয়ে যায়। এরপর কেউ কেউ অনেক সংগ্রাম করে সংসারের কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। আবার অনেকের পড়াশোনা সেখানেই থেমে যায়। একজন নারীর সংসার, সন্তান, পরিবারের সবকিছু দেখতে হয়। পাশাপাশি পড়াশোনা চালানোর সংগ্রামও করতে হয়। খুব কঠিন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় জীবনের সব স্বপ্ন বিসর্জনের অনুভূতি জানতে কথা হচ্ছিল সোমা আহমেদ ও মনি আক্তারের সাথে।
সোমা আহমেদ বলেন, আমাদের বাড়ি শরিয়তপুর। আমার চাচাতো বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েই। আমি তাদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিলাম। ম্যাট্রিক পাসের পর বিয়ে হয়নি। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলাম না। বাবা-মা এইটের পর থেকে বিয়ের কথা বলা শুরু করলেন। আমি আমাদের স্কুলের শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললাম। তাদের জানালাম যে আমি পড়তে চাই। আমার কারণেই বাবা-মা চেষ্টা করেও আমাকে বিয়ে দিতে পারেননি। যখনই কোন প্রস্তাব আসত, আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের বলতাম। তারা বাড়ি গিয়ে বলতেন যে আমি পড়তে চাই। আমাকে যেন কলেজ পর্যন্ত পড়ানো হয়। এমনি করে ম্যাট্রিকে জিপিএ ৪.৮ পেলাম। আমার জন্য অনেক ভালো ফলই ছিল। গ্রামের মধ্যেও আমার ফল ছিল অনেক ভালো। তাই এলাকার এক কলেজে বাবা-মা আমাকে ভর্তি করাতে বাধ্য হলেন। তবে আমি বেশিদিন তাদের আটকে রাখতে পারিনি। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পরপরই আমার বিয়ে হয়ে গেল।
আমার স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার সাথে আমার বয়সের অনেক পার্থক্য। বিয়ের পর শরীয়তপুর থেকে চলে এলাম ঢাকার মিরপুরে। সেখানেই তাদের বাসা এবং এই প্রথম আমার ঢাকায় আসা। আমি নিজের কাছে নিজে এক প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, পড়াশোনা চালিয়ে যাব, তা যেখানেই হোক না কেন। ভালো করার ইচ্ছা থেকেই এইচএসসিতে ফলাফল মোটামুটি ভালো হলো। জিপিএ ৪.৬। বহু বুঝিয়ে আমার স্বামীকে রাজি করালাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেব। বিয়ের পর সারাদিন বাসায় বসে পড়তাম, আর শাশুড়ি, ননদদের নানা মন্তব্য শুনতাম। এত পড়ে কি হবে, পড়াশোনার দরকার কী? এখন সংসারই সব। ইত্যাদি। তবু আমার স্বামীর সমর্থনে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পেলাম। কম কথা নয়। ফলে পরিবার আর বাধা দিতে পারেনি। আমার সাথের সহপাঠীরা তখন মাত্র জীবন শুরু করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন উপভোগ করছে। আর আমি সংসারের বোঝা নিয়ে ক্লাসে আসছি। ছুটি হলেই দৌড়ে বাড়ি যাচ্ছি। তাও দেরিতে ফেরার জন্য নানা কুমন্তব্য শুনছি। আমার সহপাঠীরা যখন শুনল আমি বিবাহিত, তারাও আমাকে একটু অন্য চোখে দেখা শুরু করল। তারা ঢাকায় বড় হওয়া বাবা-মায়ের আদরের কন্যা। এখনো কাউকে কাউকে মা টিফিন দিয়ে দেন। বাড়িতে গিয়ে তারা পড়ে, মা নাস্তা দেন। আর আমি? শ্বশুর-শাশুড়িকে সাহায্য করে, রাতের খাবার রেঁধে, স্বামীকে সঙ্গ দিয়ে, আরও কত কাজ। এরপর সকলে ঘুমিয়ে গেলে একটু পড়ার চেষ্টা করি। এভাবে আমি পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। আমি যখন তৃতীয় বর্ষে, পারিবারিক চাপে সন্তান নিলাম। সন্তান সম্ভবা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে মনে হতো ভিনগ্রহের প্রাণী। শিক্ষকরা বলতেন কেন পড়াশোনার ক্ষতি করে সন্তান নিতে গেলাম। তাদের বোঝানো সম্ভব ছিল না যে এটি আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। আমি অসহায়। তবু কোন বছর নষ্ট না করে আমি অনার্স সম্পন্ন করলাম। আমার সন্তান সেসময় এক দূর সম্পর্কের বোনের কাছে থাকত। সে না থাকলে আমার পড়া সম্পূর্ণ হতো না। আমি এরপর মাস্টার্সও করি। তবে সন্তানকে দেখাশোনাসহ নানা পারিবারিক কারণে চাকরি করতে পারিনি। কিন্তু এখনো আমার ইচ্ছা আছে, নিশ্চয় তা পূরণ হবে। আমি যে এতদূর আসতে পেরেছি এর পেছনে আমার ইচ্ছাশক্তি ছিল মূল।
মণি আক্তার থাকেন পুরান ঢাকায়। সেখানেই তার শ্বশুরবাড়ি। তার যখন বিয়ে হয়, সে সময় সে ম্যাট্রিক দিয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ। সে বলে, আমার অন্য বোনদের মাঝে আমি সবচেয়ে বেশি পর্যন্ত পড়েছি। ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ার পরও আমার বিয়ে হচ্ছে না দেখে সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে যাচ্ছিল। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকে আমাকে দেখতে এসেছে, আর চা, শরবত নিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন এটিই আমার কপালের লিখন। ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে পেরেছি, এই অনেক বেশি।
আমার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের উচ্চ পরিবারের সন্তানের সঙ্গে। তাদের ব্যবসা রয়েছে পুরান ঢাকায়। বিয়ের পর সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিলাম। তবে ঢাকায় এসে বুঝতে পারলাম আমি কি ভুল করেছি। আমার পড়াশোনার শখ ছিল, বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মেয়ে হিসেবে সমাজের প্রচলিত প্রথার কাছে নিজের সব ইচ্ছাকে বলি দিয়েছি। কখনো কখনো মনে হয়েছে মরে যাই। তবুও মেনে নিয়েছি। পরে ঢাকায় এসে পড়তে চাইলেও আমার স্বামী মানা করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়বার আর সে ইচ্ছার কথা মনে করিনি। সংসারের সব কাজ করতে হয় আমাকে। কিন্তু রিমোট কনট্রোল তো স্বামীর হাতে!
আমার একমাত্র মেয়ের বয়স পাঁচ বছর হতে চলল। আমার প্রতিজ্ঞা, আমার পড়ার অসমাপ্ত ইচ্ছা আমার মেয়েই পূর্ণ করবে। তাকে অসময়ে ইচ্ছার বলি দিয়ে বিয়ে করতে হবে না। আমাদের দেশে একজন মেয়ের এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করার অধিকার আছে কিনা, তা নিয়েও আমি সন্দিহান।
Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page