• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৪ অপরাহ্ন

টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ ভবন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ॥ তিন জনের মৃত্যু

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১৮

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি॥
টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন ভবন নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানে অনিয়ম ও অদক্ষ শ্রমিক নিয়েগের অভিযোগ ওঠেছে। সঠিক নিরাপত্তা বলয় না থাকার কারণে ইতোমধ্যে তিন জন শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন।
জানাগেছে, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণে ডেভলেপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল বা প্রোফর্মা(ডিপিপি) সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছে মোট পাঁচশ’ ৮৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার(৫৮৪১৯.৮৪ লাখ)। ওই বরাদ্দে মোট ১৭টি ভাগে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। ১৭টি ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে, মেডিকেল কলেজের সীমানা প্রাচীর, অ্যাকাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাস, ছাত্রীবাস, হাসপাতাল ভবন, স্টাফ নার্সেস ডর্মেটরি, ইণ্টার্নী ডক্টরস ডর্মেটরি(পুরুষ), ইণ্টার্নী ডক্টরস ডর্মেটরি(মহিলা), গভীর নলকূপ ও ওয়াটার রিজার্ভার এবং পানি সরবরাহের লাইন, ৬০০ বর্গফুটের আবাসিক ভবন, ইমার্জেন্সি স্টাফ ডর্মেটরি(পুরুষ-১), ইমার্জেন্সি স্টাফ ডর্মেটরি(পুরুষ-২), সিঙ্গেল ডক্টরস অ্যাকোমোডেশন(পুরুষ-১), সিঙ্গেল ডক্টরস অ্যাকোমোডেশন(পুরুষ-২), এক হাজার বর্গফুটের আবাসিক ভবন, এক হাজার ২৫০ বর্গফুটের আবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, ১৭টি ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নুরানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেড হাসপাতালের ছয়তলা বিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক ভবন, চারতলা বিশিষ্ট ছাত্রাবাস, ১৫ তলা বিশিষ্ট মূল হাসপাতাল ভবন ও ৬০০ বর্গফুটের আবাসিক ভবনের নির্মাণ কাজ করছে। হাসপাতালের ছাত্রীবাস নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রশিদ অঅরসিসিএল(জেবি), স্টাফ নার্সেস ডর্মেটরি নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস হোসাইন, ইণ্টার্নী ডক্টরস ডর্মেটরি(পুরুষ) নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন কনস্ট্রাকশন, ইণ্টার্নী ডক্টরস ডর্মেটরি(মহিলা) নির্মাণ করছে দেশ ইঞ্জিনিয়ারিং নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালের গভীর নলকূপ ও ওয়াটার রিজার্ভার এবং পানি সরবরাহের লাইন নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রশিদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, ইমার্জেন্সি স্টাফ ডর্মেটরি(পুরুষ-১) এর নির্মাণ কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডালি কনস্ট্রাকশন, ইমার্জেন্সি স্টাফ ডর্মেটরি(পুরুষ-২) নির্মাণের কাজ পেয়েছে মার্ক কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সিঙ্গেল ডক্টরস অ্যাকোমোডেশন(পুরুষ-১) ও সিঙ্গেল ডক্টরস অ্যাকোমোডেশন(পুরুষ-২) এর কাজ পেয়েছে ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া এক হাজার বর্গফুটের আবাসিক ভবন নির্মাণ ও এক হাজার ২৫০ বর্গফুটের আবাসিক ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা নির্মাণে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১৫ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবন নির্মাণের কাজ পেয়ে নুরানী কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন না করে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করে সনাতনী পদ্দতিতে নির্মাণ কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য বেল্ট, হেলমেট, জুতা, হ্যান্ড গ্লাভস্, চশমা ইত্যাদির সামান্য ব্যবস্থা রাখলেও তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেনি। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ শ্রমিক, রাজ মি¯্র,ি কাঠ মি¯্র,ি রড মি¯্র,ি ইলেক্ট্রিক মি¯্র,ি ফিটিংস মি¯্রি ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বল্প বেতনে আধা-দক্ষ ও অদক্ষদের নিয়োগ দিয়ে কোনমতে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে। বহুতল ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের ইন্স্যুরেন্স(গ্রুপ বীমা) থাকার বিধান থাকলেও কোন শ্রমিকেরই ইন্স্যুরেন্স করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উঁচু ভবন নির্মাণে ওয়াল সাপোর্টিং ব্যবস্থা থাকার বাধ্যবধকতা থাকলেও তা করা হচ্ছেনা। উঁচু ভবন নির্মাণে বহ্যিক নিরাপত্তায় বেষ্ঠনীর কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে উপর থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিচে পড়ে সাধারণ মানুষ প্রায়ই আহত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন ভবনের ছয়তলা থেকে পড়ে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নির্মাণ কাজে তারা নি¤œমানের দ্রব্য ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত ও ছবি সংগ্রহ করার পর পরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণে ছয় তলায় টির দিয়ে একটি অস্থায়ী ঘের নির্মাণ করেছে।
সরেজমিনে হাসপাতালের মূল ভবন নির্মাণে নিয়োজিত শ্রমিক শেরপুরের ফোরকান আলী(২৩), গাইবান্ধার সাইদুর রহমান(৪০) জানান, ভবন নির্মাণে শ্রমিকরা কেউ কেউ মাসিক আবার কেউ দিনমজুর হিসেবে বেতনে কাজ করছেন। রড বাইন্ডার হিসেবে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর। ময়মনসিংহের মো. সবুজ মিয়া(১২), হারুন মিয়া(১৩), রিপন মিয়া(১৪), আশিক(১৬) সহ অনেকেই জানান, তারা মাসিক ৬০০-১৪০০টাকা(খাবার ও থাকা কর্তৃপক্ষের) বেতনে কাজ করছে। তারা কেউ কেউ দিনে আবার কেউ রাতে কাজ করে থাকে। তাদেরকে কোন প্রকার ওভার টাইম দেয়া হয়না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা ও অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগেরর কারণে ১৫তলা বিশিষ্ট মূল হাসপাতাল ভবনের ছয়তলা থেকে পড়ে গত ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আইনুল ইসলাম(২২) নামে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহত আইনুল ইসলাম কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। গত ২৪ জানুয়ারি দিনগত রাতে হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনে বৈদ্যুতিক কাজ করার সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার জোরবাড়িয়া গ্রামের আশরাফ আলীর ছেলে মো. ওয়াহেদুল ইসলাম(১৮) মারা যান। অপর একজন অজ্ঞাত শ্রমিক বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন। তার নাম-পরিচয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা শ্রমিকরা জানাতে পারেনি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নুরানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম তারেকের সাথে মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ কাজ  দেখভালকারী মোস্তফা কামাল জানান, যেখানে শ’ শ’ শ্রমিক কাজ করে সেখানে এক-আধটু এদিক-সেদিক হতেই পারে। শিশু-কিশোর শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, অভাবের তাড়নায় তারা শ্রম বিক্রি করে। এ বিষয়ে লেবার সর্দাররা বিস্তারিত বলতে পারবে। লেবার সর্দারদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ কাজ দেখভালকারী টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী(এসডি)  সাকিবুল আজম জানান, তারা কনস্ট্রাকশন কাজের গুনগত মানের দিকে বেশি খেয়াল করে থাকেন।
টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ আলী খান জানান, অপ্রাপ্ত বয়স্ক তিন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। শ্রমিক নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতার বিষয়টি ঠিকাদারি কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠুভাবে করবেন বলে তিনি আশা করেন। যেভাবে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে তাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট বলে জানান তিনি।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শম্ভুরাম পাল জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে, এখানে কাজে গাফিলতি করার সুযোগ নেই। হাসপাতালের নির্মাণ কাজ তিনি সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছেন। অন্য জেলার শিশু-কিশোরদের কাজে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে বেশ কিছু শিশু-কিশোর ছিল, পরে তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যে তিন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারকে যতটা সম্ভব ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মো. আনোয়ার উল্লাহ্ জানান, প্রতিটি কনস্ট্রাকশন ফার্মেরই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স গ্রহন বাধ্যতামূলক। নুরানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেড লাইসেন্স নিয়েছে বলে তার জানা নেই। লেবার নিয়োগে নীতিমালার বাইরে কোন কিছু করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার বিধান রয়েছে।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page