• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন

দলীয় নেতাদের নির্দেশেই একরামকে হত্যা দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খুন

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী, ইন্ধন ও নির্দেশদাতা ছিল তার দলেরই তিন নেতা। এরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের তত্কালীন যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির আদেল, ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুল আবছার ওরফে জাহিদ হোসেন চৌধুরী ওরফে জিহাদ এবং ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু। এদের প্রত্যক্ষ মদদে ও নির্দেশে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন ফেনীর একাডেমি রোডের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে ৩৫ জন আসামি অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিজ গাড়ির ভেতর একরামকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। পরে দাহ্য পদার্থ দিয়ে জীপ গাড়িসহ তার লাশ সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেওয়ার দায়ে সকলেই নৃশংস ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে বিচারিক আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে রায়ে বিচারক বলেছেন, আদালতের কাছে এটা স্পষ্ট যে ভিকটিম একরামুল হকের সাথে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতা তিন আসামির (জিহাদ/আদেল/শিবলু) দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক,  ক্ষমতার ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ও বিরোধ চলছিল। যে কারণে ওই তিন আসামি নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে অন্যান্য আসামিদের বিভিন্ন রকম প্রলোভন, উসকানি ও টাকা দিয়ে একরামকে হত্যা করান। পাশাপাশি ইন্ধনদাতারা ঘটনার দিন পুরো হত্যাকান্ডটি আশপাশে অবস্থান করে মনিটরিং করেন। চাঞ্চল্যকর একরাম হত্যা মামলার রায়ে ফেনীর জেলা ও দায়রা জজ আমিনুল হক এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
গত ১৩ মার্চ এই রায় দেওয়া হয়। ১৭৪ পৃষ্ঠার রায়ে তিন নির্দেশদাতাসহ ৩৯ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয় আদালত। তবে জিহাদ চৌধুরীসহ ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১৭ আসামি পলাতক রয়েছেন। খালাস পেয়েছেন অভিযোগপত্রের এক নম্বর আসামি বিএনপি নেতা ও ফেনী জেলা তাঁতী দলের সভাপতি মাহাতাবউদ্দিন চৌধুরী ওরফে মিনারসহ ১৬ জন। ২০১৪ সালের ২০ মে সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে একরামকে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়।
ওই হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আসামি জাহিদ হোসেন চৌধুরী ওরফে জিহাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তুলে ধরে বিচারক রায়ে বলেন, এটা স্পষ্ট যে ফেনী শহরস্থ সালাম কমিউনিটি সেন্টারে বসে ওই তিন পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতা একরাম হত্যার পরিকল্পনা করে। তাদের সঙ্গে হুমায়ুন নামে আরো একজন পরিকল্পনাকারী সবসময় জড়িত ছিল। ওই হত্যাকান্ডের পেছনে ফেনীর স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দল, ঠিকাদারি ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার ও পেশি শক্তি মূখ্য ভূমিকা পালন করে। আসামি আবিদ, শিপন, সিফাত, সৈকত, অনিক, শানান, জিহাদ, মিয়া, জাহিদ, বাপ্পি, বক্কর, ইঞ্জিনিয়ার রাসেল, কাইয়ুম, পাংকু আরিফ, রুটি সোহেলসহ অনেকেই এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এদের অনেকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক চিত্র ফুটে উঠেছে। এছাড়া হত্যাকান্ডের সময় শিবলু কমিশনার ও জাহাঙ্গীর আদেল ঘটনাস্থলের আশপাশে তাদের পরিকল্পনামত বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে তাদের গ্রুপের সন্ত্রাসীদের দিয়ে একরামকে হত্যা করার নির্দেশনা দেন।
নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে- আসামি পক্ষের এমন দাবি নাকচ করে দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ১৫ জন আসামির দেওয়া দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভাষা ও বলার ধরণ স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। আর এ ধরনের একটি লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না করলে ঘটনার সত্যতা কোনভাবেই বের হত না। বিচারক বলেছেন, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টসহ সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় এই হত্যাকান্ডটি ছিল একটি বিভত্স খুনের ঘটনা। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই খুনের ঘটনা সম্পর্কে কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা মিনারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি
মিনার চৌধুরীকে খালাস দেওয়ার যুক্তিতে রায়ে বলা হয়েছে, রাজনীতিবিদদের সাথে রাজনৈতিক বিরোধ একটি সহজাত সুন্দর প্রক্রিয়া। ভিকটিম একরামের সাথে আসামি মিনার চৌধুরীর কোন ধরনের রাজনৈতিক শত্রুতা ছিল এ ধরনের কোন প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাকে সন্দেহের বশে আসামি করার বিষয়টি বাদি জেরায় স্বীকার করে নিয়েছেন। এছাড়া হত্যাকান্ডের দিন কিংবা ঘটনার আগের দিন বা ঘটনার পূর্বে ৩০ দিন আগে মিনার চৌধুরী ফেনী শহরে কিংবা তার নিজ উপজেলা ফুলগাজীতে কোন কারণে এসেছিল বা অবস্থান করেছিল- এ ধরনের কোন তথ্য-প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত নিরপেক্ষ সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্যে মিনারের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্যও দেননি। এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তা যে ২৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছে তাদের কেউ একরাম হত্যার  সাথে জড়িত দাবি করে মিনারের নাম বলেননি। ফলে এজাহারে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি নেই।
Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page