• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১০ অপরাহ্ন

নিরাপদ কর্মপরিবেশ হোক সব খাতের জন্য

আপডেটঃ : রবিবার, ৬ মে, ২০১৮

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিশ্লেষকদের পরামর্শ ছিল শুধু পোশাক খাতে নয় নিরাপদ কর্মপরিবেশ হোক সবখাতের শ্রমিকের জন্যই। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরেও তা হয়নি। রানাপ্লাজা, তাজরিন ফ্যাশন, নিমতলীর আগুন, গাজিপুরে বিসিক শিল্পাঞ্চলে বয়লার বিস্ফোরণ ও প্রতিনিয়ত নির্মাণাধীন ভবনে মৃত্যুতেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। অথচ এসময় নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া প্রতিবছরই মে দিবসকে কেন্দ্র করে নিরাপদ কর্মপরিবেশের আলোচনা হয়েছে হাজারো বার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় বাড়ছে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। শ্রমিক ও কর্মজীবীদের এই উদ্বেগ শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয় রয়েছে কর্মক্ষেত্রের বাইরেও। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা যায়। গবেষণা বলছে বিগত ১০ বছরের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে গত বছর। এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, সরকারি পরিদর্শনের ঘাটতি, প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাব ও সর্বোপরি শ্রমিক-মালিকদের সচেতনতার অভাবকেই চিহ্নিত করেছেন তারা।
জানা যায়, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধ্বংস হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই বছর রানা প্লাজাসহ কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মোট ১ হাজার ৭০৬ শ্রমিক নিহত হন। রানা প্লাজার বিয়োগান্ত ঘটনা নাড়া দেয় দেশে-বিদেশে সর্বত্র। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে শিল্প মালিক, আন্তর্জাতিক ক্রেতা, বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা নড়েচড়ে ওঠে। ওই সময়ই বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ ছিল পোশাক খাতে তো বটেই কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে সব খাতেই উদ্যোগ নেওয়া হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। শুধু পোশাক খাতের কারখানাগুলোতে ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্স এগিয়ে এলে তার সঙ্গে সহযোগিতা করে সরকার। অনিরাপদই রয়ে যায় অন্য কর্ম ক্ষেত্রগুলো। সর্বশেষ গত বছর জুলাই মাসে কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় বিসিকের শিল্পাঞ্চলে ‘মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড’ নামে একটি কারখানার ডাইং সেকশনের বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে ১০ জন শ্রমিক মারা যায়। আহত হয় আরো অনেকে। এরপরও থামেনি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা। প্রতিবছরই পরিবহন, নির্মাণ শিল্প, পোশাক কারখানায় ও গৃহ কাজে শ্রমিক-কর্মকর্তা দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এসব দুর্ঘটনার পর কয়েক দিন আলোচনা হয় তারপর আবার আগের মতোই চলে। সবপক্ষের এমন উদাসিনতায় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বাড়ছেই। বিপরীতে শ্রমিকদের পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়ছে। দুর্ঘটনার পর মালিক বা সরকারের পক্ষ থেকে নামে মাত্র যে সহযোগিতা পাওয়া যায় তা অনেক সময় আহতদের চিকিত্সার ব্যয়ও হয় না।
বিভিন্ন জরিপ বলছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরের বছর কর্মক্ষেত্রে নিহতের সংখ্যা কিছুটা কমলেও তার পরের বছর থেকেই আবার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় পরিবহন খাতে এর পরে নির্মাণ খাতে। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) জরিপ বলছে, বিগত চার বছরের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিহতে সংখ্যা সবচেয়ে বেশি গত বছর। তাদের হিসাব অনুসারে গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় গত বছর দেশে নিহত হয়েছে ৭৮৪ জন শ্রমিক। গত চার বছরের মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। চার বছরে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৫১৭ জন। আহত শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০৯।
বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) নামের একটি সংস্থার জরিপ অনুসারে ২০১৭ সালে শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রের ভিতরে ৩২১টি দুর্ঘটনায় ৪২৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এসআরএস-এর এ জরিপ শুধু যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর হিসাব থেকে পাওয়া। এর আগের বছর অর্থাত্ ২০১৬ সালে নিহত হয়েছিল ৩৪১ জন শ্রমিক।
বিলসের জরিপে বলা হয় রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরের বছর, অর্থাত্ ২০১৪ সালে ৬০৩ শ্রমিক নিহত হন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা কমে যায় প্রায় অর্ধেক। ওই বছর ৩৬৩ শ্রমিক নিহত হন। তবে ২০১৬-তে এসে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়। মারা যান ৬৯৯ জন শ্রমিক। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে শ্রমিকদের নিহত বা আহত হওয়ার এসব ঘটনা ঘটছে।
এসআরএস এর জরিপে বলা হয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৮৫৭ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক নিহত হয়েছেন কর্মক্ষেত্রে। এর আগে ২০১৬ সালে ৩৪১ জন, ২০১৫ সালে ৩৭৩ জন, ২০১৪ সালে ৩২০ জন ও ২০১৩ সালে ১ হাজার ৫১১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে রানা প্লাজায় নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ১৩৫ জন। ২০১২ সালে নিহত হওয়া ৪৯০ জন শ্রমিকের মধ্যে তাজরিন গার্মেন্টসে কর্মরত ছিলেন ১১২ জন। এছাড়া ২০১১ সালে ৩৮৮ জন, ২০১০ সালে ৩৮৩ জন, ২০০৯ সালে ২৬৫ জন, ২০০৮ সালে ৩২০ জন, ২০০৭ সালে ২২২ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন কর্মক্ষেত্রে।
প্রতিবছরই দেশের কোথাও না কোথাও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। যা কমক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের উদ্বিগ্ন করছে। সর্বশেষ গত বছর গাজীপুরে পোশাক কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত হয় ১০ জন। কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় ‘মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড’ নামের ওই কারখানার ডাইং সেকশনের বয়লার ৩ জুলাই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে চারতলা ভবনের একপাশের এক থেকে দোতলা পর্যন্ত ধসে পড়ে।
ঘটনার পরপরই কারখানার লোকজন ও এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার কাজ শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। কারখানার ভেতরের ধ্বংসস্তূপ থেকে রাতে উদ্ধার করা হয় ছয়জনের লাশ। ৪৭ জনকে হাসপাতালে পাঠানোর পর মারা যান আরও তিন জন। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন ওই এলাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
জরিপগুলোর হিসাব অনুসারে গত বছর সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা গেছেন পরিবহন খাতে। এরপরই আছে নির্মাণ শ্রমিক। ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশের (ইনসাব) হিসাব অনুযায়ী দুর্ঘটনায় হতাহত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ শ্রমিক বা তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক মিলে মিটমাট করে ফেলেন। নামমাত্র অর্থ দিয়ে বা না দিয়েই মালিক পার পান। ইনসাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পত্রিকায় নির্মাণ শ্রমিকের নিহত হওয়ার যে খবর আসে, প্রকৃত সংখ্যা তার অনেক বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর পাওয়াই যায় না।
পোশাক খাত ছাড়া অন্য খাতে শ্রমিক নিহত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, এজন্য নজরদারির কাজে থাকা লোকবল অনেক কম। তবে পরিদর্শনের ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে যে লোকবল ছিল, এখন তা তিন গুণ বেড়েছে। তারপরও সংখ্যা কম। প্রতিমন্ত্রী জানান, খাত ধরে নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করতে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ