• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

মামলার তথ্য গোপন জামিন নিচ্ছে আসামিরা

আপডেটঃ : শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮

সাইফুল ইসলাম আরিফ ওরফে বাবা আরিফ (৩০)। কার্তুজ ও এক নালা কাটা বন্দুকসহ গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে মুন্সীগঞ্জ থানা পুলিশ। এই আসামির বিরুদ্ধে আরো নয়টি মামলা রয়েছে। সে তথ্য ওই  অস্ত্র মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসব তথ্য গোপন করেই আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয় সে। শুধু অস্ত্র নয় মাদক ও ধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার তথ্য গোপন করে জামিন নিচ্ছেন আসামিরা। শুধু তথ্য গোপনই নয় হাইকোর্টের দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে প্রস্তুত করা হয়েছে ভুয়া আদেশ নামাও। সেই ভুয়া আদেশনামা দাখিলের পর  কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে ইয়াবা মামলার আসামি। সম্প্রতি ভয়াবহ জালিয়াতির এসব তথ্য উদঘাটনের পর ওই সব মামলার আসামির জামিন বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জালিয়াত চক্র ধরতে গোয়েন্দা সংস্থাকেও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভুয়া আদেশনামা প্রস্তুতের সঙ্গে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে। উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনার পরেও থেমে নেই জালিয়াতি চক্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, জালিয়াত চক্র ধরার জন্য হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিচ্ছে সে অনুযায়ী আমরা মামলা দায়ের করছি। মামলার তদন্তে যদি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে প্রায় ৪০টির মতো মামলা দায়ের করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ২৪টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি মামলা করা হয়। বর্তমানে এসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে চারটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে গাজীপুরের শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি বিল্লাল হোসেন গত ৯ মে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিন আবেদনে ধর্ষণের প্রমাণ সংক্রান্ত মেডিক্যাল রিপোর্ট বদলে দিয়েছেন তার আইনজীবী। মূল রিপোর্টে ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও জামিন আবেদনে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি শিশুটিকে প্রাপ্ত বয়স্ক দেখানো হয়েছে। বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ২১ বছর। যদিও মামলার মূল নথিতে শিশুর বয়স উল্লেখ রয়েছে ১০ বছর। গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে জামিননামা দাখিলের পর জালিয়াতির বিষয়টি ধরার পড়ে। পরে হাইকোর্টের নজরে আনা হলে মূল নথি পর্যালোচনা করে আসামির জামিন বাতিল করে দেয়।
এদিকে বাস থেকে নামিয়ে এক বাক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের মামলায় বৃহস্পতিবার জামিন চান চালক বাদশা মিয়া। তার আইনজীবী দাবি করেন, মামলার আরেক আসামি হেলপার মো. ফারুককে জামিন দেওয়া হয়েছে। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফারুকের জামিন সংক্রান্ত নথি তলব করে আদালত। দুটি নথি পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট দেখতে পায় যে, দু’জন আসামিই ধর্ষণের ঘটনায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে আদালতে। কিন্তু অভিযোগপত্র ও দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য গোপন করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে ফারুক। জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ায় বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ ফারুকের আইনজীবী হারুন অর রশিদ ও জামালউদ্দিনকে তলব করেছে। রবিবার তাদেরকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এইদিন জালিয়াতি সংক্রান্ত আরো পাঁচ আবেদনের ওপর আদেশের জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে।
জালিয়াতির ঘটনা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও বার কাউন্সিল ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম বলেন, আদালতে যে আইনজীবী মামলা উপস্থাপন করছেন তিনি প্রকৃতপক্ষে আইনজীবী কিনা এবং তার স্বাক্ষরে মামলা দাখিল হলো কিনা বিষয়টি কঠোরভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মামলার তদবিরকারক হিসেবে যিনি থাকেন তিনি প্রকৃত ব্যক্তি কিনা অর্থাত্ ভুয়া ব্যক্তির মাধ্যমে এফিডেভিট সম্পন্ন হচ্ছে কিনা সেক্ষেত্রেও নজরদারি দরকার। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে জালিয়াতির ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের প্রতি কোনোরূপ অনুকম্পা না দেখিয়ে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে ভুয়া আদেশনামা
গত বছরের ৭ জানুয়ারি ২২ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. সেলিমউদ্দিন, মো. রফিক, শিরিন সুলতানা, আপন মজুমদার ও দীপক দাসকে আটক করে পুলিশ। পরদিন এ ঘটনায় চট্টগ্রামের বায়েজীদ বোস্তামী থানায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার আসামি মো. রফিক চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টে জামিন চান। সেই জামিন আবেদনের শুনানিতে আসামির আইনজীবী বলেন, হাইকোর্টের এই বেঞ্চ থেকে গত ১৩ ডিসেম্বর মামলার প্রধান আসামি মো. সেলিমউদ্দিন ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। এই জামিন পাওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে আদালতকে জানায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তখন হাইকোর্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখতে পায় যে, দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে ভুয়া আদেশনামা প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই ভুয়া আদেশনামা দাখিল করে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে আসামি সেলিমউদ্দিন। আর ওই আদেশনামায় আসামি পক্ষে যে আইনজীবীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপরই হাইকোর্ট ঘটনাটি তদন্তে সিআইডিকে নির্দেশ দেয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ