• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৪ পূর্বাহ্ন

ভূঞাপুর গোবিন্দাসী গরুর হাটে ক্রেতা নেই ॥ স্থায়ী ইজারার অভাবে হারাচ্ছে ঐতিহ্য

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট টাঙ্গাইল ভূঞাপুরের গোবিন্দাসী হাট উন্নয়নে তদারকি, রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থায়ী ইজারা না দেয়ায় হাটটি ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এ বছর ১২ সপ্তাহের জন্য অস্থায়ী ইজারা দেয়া হয়েছে। কিন্তু হাটে গরু আমদানি হলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে। অথচ এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি গোবিন্দাসী গরুর হাট। এতে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাচ্ছে। জানা গেছে, টাঙ্গাইল শহর থেকে বঙ্গবন্ধুসেতু হয়ে ৩১ কি.মি., ভূঞাপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কি.মি. এবং বঙ্গবন্ধুসেতু থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে যমুনার কোল ঘেষে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসীতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট অবস্থিত। গোবিন্দাসীতে সপ্তাহের রোব ও বৃহস্পতিবার এই দুই দিন হাট বসে। তবে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের এক মাস আগে থেকে প্রতিদিনই গরু কেনা-বেচা হয়। সিলেট, রাজশাহী, রংপুর বিভাগ ছাড়াও ভারত থেকে হাজার হাজার গরুর সমাগম ঘটে এবং গরুর ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় পুরো গোবিন্দাসী মুখরিত হয়ে ওঠে। গরু ভর্তি শ’ শ’ ট্রাকে হাটের তিনদিকে জট লেগে থাকে। এ সুবাধে হাট এলাকায় দোকানপাট গড়ে ওঠার পাশাপাশি কেউ হোটেল করে জীবিকা নির্বাহ করছে, কেউ চা-পান বিক্রি করছে, কেউ গরুর গোয়াল ভাড়া দিচ্ছে, কেউ গরুর খাবার খর বিক্রি করছে।
মোদ্দা কথা, গরুর হাটকে কেন্দ্র করেই অত্রাঞ্চলের রাজনীতি-অর্থনীতি আবর্তিত হচ্ছে। গোবিন্দাসীসহ অত্রাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান দিচ্ছে এই হাট। এই হাটকে ঘিরে এতদাঞ্চলের অনেকেই নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ষাটের দশকে গোবিন্দাসীতে ছোট আকারে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত গোবিন্দাসী একটি ছোট বাজারই ছিল। চরাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতো। ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে সপ্তাহে দুইদিন রোববার ও বৃহস্পতিবার হাট বসানো হয়। সে সময় সাধারণত বিকালে হাট বসতো। সন্ধ্যার পর ‘মশাল’ বাতি জ্বালিয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত দোকানপাট চালানো হতো। তখন স্থানীয়রা ৮-১০টা করে করে গরু-ছাগল হাটে তুলে বিক্রি করার চেষ্টা করে। কখনো বিক্রি হয়, আবার কখনো হয়না। ১৯৯৫ সালে সরকারিভাবে গোবিন্দাসী হাটের প্রথম ইজারা হয়। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা গোবিন্দাসী হাটটি মাত্র ৩২ হাজার টাকায় ইজারা নেন। ইজারার টাকা ওঠাতে তিনি হাটটির ব্যাপক প্রচারণা চালান। গোবিন্দাসী হাটটিতে নদী ও স্থল পথে যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে দেশের সিলেট, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের গরু ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদেরকে হাটে আনতে নানা রকম প্রণোদনা চালু করেন। যেমন রংপুর, রাজশাহী বিভাগ ও ভারত থেকে গোবিন্দাসী হাটে গরু আনলে যমুনা নদীর পাড়াপাড়ের জন্য ফেরি ফ্রি, হাটে গরুর পাহারা ফ্রি এ রকম হরেক রকম প্রণোদনা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাটমুখো করতে ট্রাক নিয়ে বিভিন্ন জেলায় মাইকিং করা হয়। ধীরে ধীরে গোবিন্দাসী গরুর হাটের প্রসারতা বাড়ে, জমে ওঠে গোবিন্দাসী গরুর হাট। বর্তমানে হাটটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট হিসেবে বিবেচিত। স্থানীয় পর্যায়ে প্রবাদ আছে, যিনি গোবিন্দাসী হাটে গরুর গোবর কুড়াতেন তিনিও এখন কোটিপতি। হাটের আশপাশের বসবাসকারীদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে এই হাট। অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বছরে পৌনে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বাৎসরিক ইজারামূল্য হয়। অথচ গোবিন্দাসী হাটের কোন নিজস্ব সম্পত্তিই নেই। স্থানীয় আ’লীগ নেতা ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধার নেতৃত্বে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভূঞাপুর ফেরিঘাট সড়কের পাশে বিবিএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন বঙ্গবন্ধুসেতুর অধিগ্রহনকৃত তিন সড়কের মাথায় কুকাদাইর মৌজায় স্বল্প পরিসরে গোবিন্দাসী হাট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা একটানা ৯ বছর হাটটির ইজারা নেন। স্থানীয়দের কাছে গোবিন্দাসীর নৌ পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকাটি স্থানীয়দের কাছে টি-মোড় হিসেবে সমধিক পরিচিত। সড়ক ও নদী পথে যাতায়াতে সুবিধার কারণে হাটটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে হাটের প্রধান গেট নির্মাণ ও গরু-মহিষের পানি খাওয়ানোর জন্য আলাদা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশে গড়ে ওঠেছে গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল। প্রতিটি মাত্র ১০ টাকায় আবাসিক হোটেলে গরু-মহিষ রাখা, গোসল করানো ও পানি খাওয়ানোর সুবিধা পাওয়া যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিগত ১৪২১ বাংলা সনে দুই কোটি ৮৫ লাখ ৩০ হাজার, ১৪২২ সনে দুই কোটি ৯১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৪ টাকা, ১৪২৩ সনে দুই কোটি ৮৭ লাখ ৩ হাজার ২৬০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। ১৪২৪ সনে স্থায়ী ইজারা না দেয়ায় সরকারি খাস খালেকশনে মোট আদায় হয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ৯০০ টাকা। সরকারি খাস খালেকশনে ১৪২৫ সনের প্রথম ২৫ সপ্তাহে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ১০০ টাকা। চলতি বছর ১২টি হাটের জন্য ৪৭ লাখ ১০ হাজার টাকায় স্থানীয় হান্নান সরকার ও মো. লিটন মন্ডলকে ইজারা দেয়া হয়েছে। গোবিন্দাসী গরুর হাট সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, স্থায়ী ইজারা না দেয়ায় একদিকে সরকার যথাযথ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে গোবিন্দাসী হাটটি অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। গরু হাটে নিয়ে আসা শামসুল, আহাম্মদ আলী, মোসলেম উদ্দিন সহ অনেকেই জানান, তারা গত দুই হাট যাবত গরু এনেছেন- কিন্তু ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারছেন না। যারা আছেন তারাও দাম বলছেন খুবই কম। ফলে গরু বিক্রি করতে পারছেন না। আরো একটি হাট দেখে তারা অন্য হাটে গরু নিয়ে যাবেন বলে জানান। ইজারাদার মো. লিটন মন্ডল জানান, স্থায়ী ইজারা পেলে হাটে গরু-মহিষ আনায় প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু সরকারি খাস কালেকশনে তা একবারেই হয়না। ফলে কয়েক বছরে হাটের চৌদ্দটা বেজে গেছে। তিনি হোবিন্দাসী হাটটির ঐতিহ্য রক্ষায় স্থায়ী ইজারা দেয়ার দাবি জানান। তিনি জানান, এ বছর ১২ সপ্তাহের অস্থায়ী ইজারা নিয়ে গত ৬টি হাটে মোট ৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা খাজনা আদায় করেছেন। এরমধ্যে প্রথম হাটে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা টোল আদায় করা হয়েছে, দ্বিতীয় হাটে ৯১ হাজার, তৃতীয় হাটে এক লাখ ৫৯ হাজার, চতুর্থ হাটে এক লাখ ১১ হাজার, পঞ্চম হাটে এক লাখ ১৪ হাজার এবং ষষ্ঠ হাটে এক লাখ ৭ হাজার টাকা টোল আদায় করা হয়েছে। বয়সের ভারে ন্যূব্জ গোবিন্দাসী হাটের তত্ত্বাবধায়ক আ’লীগ নেতা ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা জানান, তিনিই স্থানীয় লোকদের নিয়ে গোবিন্দাসী গরুর হাট প্রতিষ্ঠা করেন। মাইকিং করে, প্রণোদনা দিয়ে, বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে পাইকার ও ক্রেতাদের হাটমুখো করেছেন। হাট উন্নয়নে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সরকারি সুবিধা না পাওয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। ব্যক্তি ও ইজারাদারের কল্যাণে কিছুটা উন্নয়ন করা হয়েছে। তবে স্থায়ী ইজারা না থাকায় হাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝোটন চন্দ জানান, গোবিন্দাসীসহ অত্র অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের কর্ম সংস্থান দিচ্ছে এ গরুর হাট। শুনেছি, এই হাটকে ঘিরে অত্রাঞ্চলের অনেকেই নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সবারই দায়িত্ব হাটটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উপজেলা প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। তিনি আগামিতে গোবিন্দাসী হাট স্থায়ী ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম বলেন, সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরু-মহিষের হাটটির বারোটা বাজিয়ে গেছেন। আমাদের কারো কথা না শুনে তাঁর পছন্দের কয়েক ব্যক্তিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে একক সিদ্ধান্তে তিনি খাস কালেকশনের মাধ্যমে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করে হাটটির ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছেন। বর্তমান ইউএনও ১২ সপ্তাহের জন্য ইজারা দিয়েছেন। আশা করা যায়, আগামিতে হাট স্থায়ী ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

 

 

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page