টাঙ্গাইল প্রতিনিধি॥
টাঙ্গাইলের গোহালিয়াবাড়ী ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক এবং দেউপুরস্থ মাস্টার হ্যাচারি ও যমুনা মৎস্য খামারের পরিচালক আনিছুর রহমান ওরফে তুলা মুন্সী হত্যাকান্ডের জট দীর্ঘ দুই মাসেও খুলতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি)। মূলত: কোন ক্লু-ই বের করতে পারেনি পুলিশ। হত্যার কারণ হিসেবে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তুলা মুন্সীকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, পরকীয়ার জের বা পারিবারিক কলহ।
সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ও টাঙ্গাইল-৪(কালিহাতী) সংসদীয় আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশি ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলীর ছোট ভাই আনিছুর রহমান। দেউপুর গ্রামের মরহুম আ. ছাত্তার সরকারের ৬ ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আনিছুর রহমান চতুর্থতম। তিনি গোহালিয়াবাড়ী ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি দেউপুর এলাকার মাস্টার হ্যাচারি ও যমুনা মৎস্য খামার পরিচালনা করতেন। হ্যাচারিতে রেণু ফুটিয়ে তিনি এলাকার ৬৫টি পুকুরে মাছ চাষ করতেন। এক ছেলের জনক আনিছুর রহমান স্থানীয়দের কাছে তুলা মুন্সী হিসেবেও পরিচিত। হ্যাচারি ও মাছের খামার পরিচালনা নিয়ে স্থানীয় বা সংশ্লিষ্ট কারো সাথে তাঁর কোন প্রকার বিরোধ ছিলনা বলে জানা যায়। ভাই-বোনরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, তাদের মধ্যে কোনও মনকষাকষি ছিলনা।
গত ২৭ জুন রাত সাড়ে ৮টায় আনিছুর রহমান তাঁর স্ত্রী শাহীনা আক্তারকে ফোন করে জানান, তিনি সল্লা বাসস্ট্যান্ডে আছেন। তারপর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে তার ভাই অধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফা কালিহাতী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-১৩০৭, তাং-২৮/০৬/২০১৮ইং) করেন।
স্থানীয় আ. ছালাম, আব্দুল খালেক, হযরত আলী তালুকদার, আনছের আলী, মো. ফারুক, রমজান আলী, শমসের আলী সহ অনেকেই জানান, তুলা মুন্সীর কাছে কেউ টাকা পাওনা হলে তিনি বাড়িতে গিয়ে পাওনা পরিশোধ করতেন। তাঁর মতো একজন ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাঁর ভাই ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি উপজেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি(১)। কালিহাতী উপজেলার প্রায় সব মসজিদ-মাদ্রাসা, ক্লাব-সমিতি, গোরস্থান-মন্দির এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত অনুদান দিয়ে তিনি সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। আগামি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে-ঘাটে কাজ করে যাচ্ছেন। দেউপুর এলাকার জনসাধারণ এখন তাঁর পক্ষে একতাবদ্ধ। দলীয় মনোনয়নের দৌঁড়ে ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলী তৃণমূল আ’লীগের এক প্রিয়মুখ। ফলে বর্তমান এমপি হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারির বিরাগভাজন হন তিনি। এমপি সোহেল হাজারির লোকজন তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে। ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে দুর্বল করার জন্য ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে থাকতে পারে এমনটাই বলছেন পরিবারের লোকজন।
কালিহাতী থানায় জিডি করার পর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনিছুর রহমান ওরফে আনু মেম্বার, বাছেদ তালুকদার ও তাদের লোকজন নিখোঁজ তুলা মুন্সীর ভাই শহিদুল ইসলাম কাশেমকে ফোন করে জানায় ‘তুলা মুন্সী ঢাকায় স্ট্রোক করেছে; তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আছেন’। তারা কথাটি এলাকায় প্রচারও করেন। ওইদিনই বিকালে তাঁদের বাড়ির পুকুর থেকে হাত-পা বাঁধা ও কোমরে বস্তায় ৭টি ইটবাঁধা অবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষক আনিছুর রহমান ওরফে তুলা মুন্সীর মরদেহ উদ্ধার হয়।
দেউপুর গ্রামের কয়েক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, দেউপুর গ্রামের আনিছুর রহমান ওরফে আনু মেম্বার(৪৫), তার ছেলে আরিফ(২২), আনু মেম্বারের চাচাত ভাই ও আজাহারুলের ছেলে শহিদ(৪২), ভাতিজা ও নিয়ামত আলীর ছেলে মাহবুব(৩২), মৃত কোরবান আলীর ছেলে শাহজাহান(৪২), মৃত মজিদ তালুকদারের ছেলে আ. বাছেদ তালুকদার(৬০), সাবেক মেম্বার নুর হোসেনের ছেলে খোরশেদ আলম(৫০) সহ আরো কিছু ব্যক্তি এমপি সোহেল হাজারির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অনুসারী। রাজনৈতিক কারণে তারা ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলীর বিরাগভাজন।
এদিকে, আনিছুর রহমান ওরফে আনু মেম্বারের বোন জামাই স্বপনের ছেলে শাওন। তাঁদের বাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরাঞ্চল হীরাগোটা গ্রামে। তারা এলেঙ্গা পৌরসভায় ‘শাওন অফসেট প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট’ নামে প্রেস ব্যবসা পরিচালনা করেন। গত ২৫ জুন ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলীর বডিগার্ড মো. কামাল হোসেনের ভাই সোহাগের সাথে শাওনের ঝগড়া হয়। ওইদিন রাতে আনু মেম্বারের বোন শাহিদা মোবাইল ফোনে ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলীকে ওই ঝগড়ার জন্য দায়ী করে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। মায়ের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ছেলে শাওন ও শাহিদার স্বামী স্বপনও ক্ষুব্ধ হয়।
শাওনদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হীরাগোটা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এলাকাটি এক সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ‘পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির(লাল পতাকা) অভয়ারণ্য ছিল। বিগত ২০১৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ওই এলাকার যুগনী গ্রামের দলীয় আব্দুল বাছেতের স্ত্রী জমেলা বেগম(৩৮) নিখোঁজ হন। ঘটনার তিনদিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর জমেলা বেগমের লাশ যুগনী স্লুইচগেটের কাছে সিমেন্টের খুঁটির সাথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার হয়। প্রায় তিন বছর পর প্রায় একইভাবে কোমরে ইটবাঁধা অবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষক আনিছুর রহমান ওরফে তুলা মুন্সীর মরদেহও পাওয়া যায়। যুগনীর গৃহবধূ জমেলা বেগম ও মাদ্রাসা শিক্ষক তুলা মুন্সী খুনের এ ধরণে অনেকটা সর্বহারা’র ভাড়াটিয়া সদস্যদের অপারেশনের সাদৃশ্য বিদ্যমান।
এ ঘটনায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ নিহতের ভাই সহ ৪ জনকে আটক করে। পরে নিহতের দুই ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হয় এবং অপর দুই ব্যক্তি মৎস্য হ্যাচারির ডাক্তার সুজন ও সল্লা প্রামাণিক মার্কেটের দোকানদার মোতালেবকে আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠানো হয়। গোয়েন্দা পুলিশ নিহত আনিছুর রহমান ওরফে তুলা মুন্সী হত্যাকান্ডের কোন ক্লু এখনও জানতে পারেনি। তবে, ৩-৪টি বিষয়কে মাথায় রেখে খুটিনাটি বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে।
সল্লা ইউনিয়নের সদস্য আনিছুর রহমান ওরফে আনু মেম্বার জানান, তুলা মুন্সীর মত একজন ভালো মানুষকে কেউ খুন করতে পারে- এটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছেনা, তবুও ঘটনা যখন ঘটেছে তখন বাড়ির মানুষই বলতে পারবে। তিনি মনে করেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে এ হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে।
টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের সদস্য ও নিহত তুলা মুন্সীর ভাই ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলী জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-৪(কালিহাতী) আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশি। এজন্য বর্তমান এমপি হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি তার প্রতিপক্ষ। রাজনীতিতে তাকে ‘দুর্বল’ করার জন্য এমপি সোহেল হাজারি তার লোকজন দিয়ে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের(উত্তর) অফিসার ইনচার্জ আবু ওবায়দা জানান, তুলা মুন্সী হত্যাকান্ডটির তদন্ত তাদের হাতে থাকলেও র্যাব, পুলিশ ও পিবিআই ছায়া তদন্ত করছে। এখনও পর্যন্ত কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি। তবে, দ্রুতই এ ঘটনার মূল রহস্য উন্মোচিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
You cannot copy content of this page