• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৭ অপরাহ্ন

পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা তিস্তা সেতু ঘিরে

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮

লালমনিরহাট প্রতিনিধি॥
ঈদ বা পুজা অথবা মানুষের  যে কোন ছুটির দিনটা যে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের প্রবেশমুখে রংপুরের তিস্তা সড়কসেতু এখন মানুষে মানুষে টইটম্বুর। ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে খোলা হাওয়ায় নির্মল আনন্দ পেতে সব বয়সী মানুষ ভিড় করছেন মরা তিস্তা পাড়ের এই সেতুতে। কিন্তু এখানে দীর্ঘ আট বছরেও গড়ে ওঠেনি বিনোদনের জন্য পার্ক, ছাউনি, টয়লেটসহ দর্শনার্থীদের জন্য কোনো সুবিধা। ফলে এই সেতু ঘিরে পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা থমকে আছে।
লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের সাথে রংপুরসহ গোটা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্রিটিশ আমল থেকেই নেই। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার রংপুরের কাউনিয়া ও লালমনিরহাটের সদর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করলে শুধু ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। কিন্তু ১৯৩৮ সালে সেই সেতুটির মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওই রেলসেতুতে কাঠের পাটাতন দিয়ে সকল প্রকার যান চলাচলের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে ই জেলার বাসিন্দারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করে আসছিলেন। এই বাস্তবতায় এখানে দুই শ’ বছর ধরে দাবি ওঠে একটি সড়কসেতু নির্মাণের। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয় রংপুর অঞ্চলের স্বপ্নবিভোর মানুষগুলোর দুই শ’ বছরের দাবি, অনেক আন্দোলন, শঙ্কার বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা সড়কসেতু। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।
অব্যাহত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ে সেতুটির পূর্ব পাশে ২০০১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তিস্তা সড়কসেতু’র ভিত্তি স্থাপন করেন। এরপর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ সেতুটি নির্মাণের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় সেতুটির নির্মাণকাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। এরপরই কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে তিস্তা সড়কসেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সেতু-৩ প্রকল্পের আওতায় ৭৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১২ দশমিক ১ মিটার প্রস্থের তিস্তা সড়কসেতু ও ২ দশমিক ২৯২ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৭৫০ মিটার ব্যাংক প্রটেকশনের এই সেতুর নির্মাণব্যয় ধরা হয় ৮৭ কোটি ৬ লাখ ৪ হাজার ৩৬ টাকা। কিন্তু ৫ দফায় সময় বৃদ্ধির কারণে প্রকল্প ব্যয় ৩৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২২ কোটি ৪ লাখ টাকায়। আমিন-ডেলিম-আসকো জেভি নামে যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণ করে। আর এর দেখভালের দায়িত্ব পালন করে বিসিএল-টায়েফ-ইস্টুপ জেভি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেতুটি খুলে দেয়া হলে এ অঞ্চলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়। পুরনো রেলওয়ে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাকে।
উদ্বোধনের পর থেকেই প্রতিদিনই এই সেতুটিকে দেখতে আশপাশ এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন এই তিস্তা পাড়ে। একটি নতুন সেতুর পাশে পুরনো রেলওয়ে সেতু, মাঝ দিয়ে বয়ে চলা মরা তিস্তার বিভিন্ন সময়ের খেয়ালি ভাব উপভোগ করতে আসা মানুষ একটু জিরিয়ে সময় নিয়ে দেখতে চান। বিশেষ করে
সন্ধ্যায় এখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অনেক বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। দুই ঈদ, পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ও বড়দিনসহ বিভিন্ন পার্বনে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে টইটম্বুর থাকে এই তিস্তার বেলাভুমি। বিশেষ করে প্রতি শুক্র ও শনিবার মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। দাবি ওঠে সেতুটিকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছরেও এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সময়ের ব্যবধানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু মানুষ স্পিড বোট ও নৌকার ব্যবস্থা করেছে। দর্শনার্থীরা সেগুলোতে উঠে দুই সেতুর মাঝ দিয়ে তিস্তার পানির আনন্দ উপভোগ করেন। কিন্তু এখানে কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। এতে নারী ও শিশু দর্শনার্থীরা সময় নিয়ে থাকতে পারেন না। শিশুদের বিনোদনের জন্য কোনো রাইড স্থাপন করা হয়নি। ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসে খোলা আকাশের নিচে। প্রচন্ড রোদে এখানে কোনো জায়গা নেই একটু বিশ্রাম নেয়ার।
শনিবার সন্ধ্যার আগে দেখা গেছে পুরনো সেতুর বিভিন্ন গার্ডার এবং সেতুর ভেতরে ও পাটাতনের ওপর মানুষে মানুষে ঠাসা। কিন্তু সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। দর্শনার্থীরা এ কথা জানেন না। তাদেরকে এ কথা জানিয়ে দেয়ার মতো কোনো লোকও পাওয়া যায়নি সেখানে। এ ছাড়া পুরো মার্জিনাল ডাইক বাঁধে এলোমেলো মোটরসাইকেল ও ভ্রাম্যমাণ দোকানের কারণে দর্শনার্থীরা ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন না। সেটা দেখারও কেউ নেই। উপরোন্তু ওই মার্জিনাল ডাইক বাঁধের ওপরেই কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে দেখা গেছে বেঞ্চ নিয়ে বসে থাকতে।
স্পিড বোট ও নৌকায় একবার ঘুরে আসার জন্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও অনেক মাঝি লোক বুঝে ১০০ থেকে ২০০শ টাকা নিচ্ছেন। সেসব দেখার কেউ নেই সেখানে।
নাছির নামে এক মাঝির নৌকায় উঠেছিলেন রণজিত দাস ও তার দুই সহকর্মী। একবার ঘুরে আসার পর তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় ১৫০ টাকা। ঈদ পারবতে বখশিশ হিসেবে ৩০০ থেকে ৫০০শ টাকা নেয়া হয়। কিন্তু একইভাবে ঘুরে আসা আরেক নৌকাওয়ালা জনপ্রতি নেন ২০ টাকা করে। বিষয়টি নিয়ে নাছিরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি জানান, এখানে যার কাছে যেমন পাই, সে রকমই টাকা নেয়া হয়। অপরিচিত লোকদের কাছে একটু বেশি নেই। নাছির জানালেন, গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তার আয় হয়েছে ৫ হাজার ৩৪০ টাকা।
পুরনো সেতুর পাশে দর্শনার্থী সানজিদা ইমরান জানালেন, এখানে এতো সুন্দর একটা ঘোরার জায়গা, কিন্তু কোনো টয়লেট নেই। শিশুদের জন্য রাইড নেই। সন্ধ্যার পর এখানে থাকা যায় না। বাজে ছেলেদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
নতুন সেতুর ওপর কথা হয় আজিজুল ইসলাম নামে একজন সরকারি কর্মকর্তার সাথে। তিনি জানালেন, সেতুটিকে ঘিরে পর্যটন কর্তৃপক্ষের অনেক আগেই পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু কেন তা করা হচ্ছে না বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। এভাবে সম্ভাবনাকে নষ্ট করা ঠিক নয়।
ঘুরতে আসা ডাইক বাঁধে শিশুসন্তানকে নিয়ে বসে থাকা সিরাজুল ইসলাম জানালেন, এখানে সব জিনিসের দাম বেশি। কিন্তু মান খারাপ। শিশুরা একটা খেলনা পছন্দ করলে দোকানদাররা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকান। উপায় না থাকায় অভিভাবকেরা চড়া দামেই কিনে দিতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ এখানে নির্মল বিনোদনের জন্য আমরা আসি। সরকারের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
ওই এলাকার য়োরম্যান গোলাম মোস্তফা স্বপন জানান, শুরুতেই এই সেতু ঘিরে এলাকাবাসী একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং সন্ধ্যার পর এখানে দর্শনার্থীরা নিরাপত্তার কারণে আর থাকতে চান না। অথচ এখানে মার্জিনাল ডাইক বাঁধের ওপর ছাতা করে দিলে বিশুদ্ধ বাতাসে দর্শনার্থীরা বসে তিস্তার ভাঙা-গড়ার খেলা উপভোগ করতে পারতেন। তিনি বলেন, সরকার পর্যটন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে অথবা বেসরকারিভাবে লিজ দিয়েও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এতে সরকার বিশাল অঙ্কের রাজস্ব পাওয়ার পাশাপাশি মানুষের খোলা স্থানে নির্মল আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
এ ব্যাপারে সেতুটির তদারককারী প্রতিষ্ঠান লালমনিরহাট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশল আলী নুরায়েন জানান, সেতুটিকে ঘিরে কিভাবে পর্যটনকেন্দ্র্র গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে আমরা সরকারের উপর মহলে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। উপর থেকে জট খুললেই সেতুটিকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। কারণ এত সুন্দর একটি নান্দনিক সেতু দেখতে মানুষ সব সময় আসতেই থাকবে।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page