• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন

তালিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তি ও চেয়াম্যান-মেম্বারদের স্বজন

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি॥
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ^রী উপজেলায় আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের পরিবর্তে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভূক্তিকরণ, ঘর নির্মাণে নি¤œ মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, দায়সারাভাবে ঘর নির্মাণসহ সুবিধাভোগিদের কাছ থেকে উৎকোচ ও পরিবহন খরচ নেবার অভিযোগ উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আশ্রয়ন প্রকল্পের নীতিমালায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)র মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কাজ করার কথা থাকলেও পিআইসি‘র সভাপতি তার একক ক্ষমতাবলে তার পছন্দের অফিস স্টাফ দিয়ে কাজ করছেন। পিআইসি সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই কাজের ঠিকাদারী হিসেবে আছেন বলে জানা গেছে। সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ পাঁচ সদস্যের অন্যান্য সদস্যরা হলেন পিআইও (সদস্য সচিব), উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা সহকারী কর্মকর্তা (ভুমি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ।
ঘর প্রাপ্ত সুুুবিধাভোগীদের অভিযোগ ঘর নির্মাণে মানা হয়নি সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম। নি¤œমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিটি ঘর। ১৭৫ বর্গফুটের ঘর নির্মানে কাঠের দরজা জানালা তৈরিতে শাল, গর্জন, জামরুল, কড়ই, আকাশ মনি প্রভৃতি কাঠ ব্যবহারের কথা থাকলেও নি¤œমানের আম ও ইউক্লিপটার্স গাছের কাঠ দিয়ে তড়িঘরি করে কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। ফলে ঘরের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে সুবিধাভোগী সহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সিডিউলে ১৭৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ঘরে ৪ বর্গ ইঞ্চি ১২টি পিলারের উচ্চতা ১২ ফুট মূল ঘর ও বারান্দা এবং ল্যাট্রিনে ৯টি খুটি ১০ ফুট ৬মিলিঃ ৪টি করে রড দেয়ার নিয়ম থাকলেও ১২টি পিলার ১০ ফুট করে এবং ৯টি পিলার ৮ ফুট করে ৬মিলিঃ রডের স্থলে ৪মিলিঃ ৩টি করে রড এবং রিং ৪মিলিঃ রডের পরিবর্তে মোটা তার ও নি¤œমানের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ঘরের ঢেউটিন ০.৩৬ মিঃমিঃ এর স্থলে ০.২৬মিঃমিঃ দেয়া হয়েছে। ৪টি জানালায় লোহার গ্রিল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। ঘর ও বারান্দার মেঝে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চি ধরা থাকলেও ১-২ ইঞ্চি দিয়ে ঘরের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। পিএল এর ইটের গাথুনি ১ফুট ৯ ইঞ্চি করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে করা হচ্ছে ১ ফুট এবং ব্যবহার করা হচ্ছে নি¤œমানের ইট ও খোয়া। এছাড়া ল্যাট্রিন নির্মানে ৮টি করে রিং স্লাব ব্যবহারের কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে ৬টি করে রিং স্লাব।
প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের জন্য ঘর নির্মানে প্লান ডিজাইনে প্রাক্কলন মোতাবেক কাজ করা হয়নি। প্রতিটি ঘর ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মানের কথা থাকলেও তা ৪০-৫০ হাজার টাকায় সম্পন্ন করা হচ্ছে। আর এ কাজ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এর সহযোগীতায় একক ভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাস্তবায়ন করছেন বলেও অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। মেঝে পাকা করণের কাজে বালু এবং পলিথিন কিনে দিতে হয়েছে সুবিধা ভোগীদের। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো শেষ হয়নি ঘর নির্মাণের কাজ।
কেদার ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সুবলপাড় গ্রামের ঘর পাওয়া দুলালী জানান, ঘর নির্মাণের যাবতীয় উপকরণ পরিবহন, পলিথিন, বালু, ধর্ণার বাশ সে কিনে দিয়েছে। এতে তার ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে কচাকাটা ইউনিয়নের তরিরহাট এলাকার রওশনারা, বল্লভের খাষ ইউনিয়নের দামাল গ্রামের বাসিন্দা আমির আলী। হাসনাবাদ ইউনিয়নের সুবিধা ভোগি হালিমা বেগমের স্বামী কলিমুদ্দিন জানান, উল্লেখিত খরচের পাশাপাশি তাকে দুই বস্তা সিমেন্টও কিনে দিতে হয়েছে নাগেশ^রী উপজেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অফিস সুপার (ওএস) জিল্লুর রহমানকে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার্র মনোনিত আকতার হোসেন জানান, ১ লাখ টাকা বরাদ্দের ঘরের কাজের মধ্যে কাঠ, বালু, ইট, পলিথিন, নির্মাণ ব্যয় এবং ল্যাট্রিন বাবদ ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা কন্ট্রাক নিয়েছি। টিন, খুটি এবং পরিবহনের বিষয় ইউএনও স্যার জানেন। এদিকে অজানা কারণে তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে স্বচ্ছল ব্যক্তি ও চেয়াম্যান মেম্বারদের স্বজন। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে নিত্যন্ত গরীবরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে কেদার ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর মজিবর রহমান। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ৭ সদস্যের সংসার। থাকার মতো ৭শতক জমিতে একটি জীর্ণ কুটির। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢোকে দিনের আলো আর রাতের জোৎ¯œা। পুরাতন টিনের ফুটো দিয়ে পড়ে বৃষ্টির পানিও। মজিবর রহমানের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মেম্বারদের পিছে ঘুরে মেলেনি একটি ঘর। ঘর দেয়ার কথা বলে ইউপি সদস্য তার জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়েছেন, এখন সেটাও খোয়া গেছে। একই অবস্থা কচাকাটা ইউনিয়নের দক্ষিন সরকারটারী গ্রামের ফজিরন বেওয়ার ৩ বছর আগে থাকার অনুপযোগী হয়ে পড়ে তার ঘর। অথচ তার পাশেই মেম্বারের স্বচ্ছল জামাতা রকুনুজ্জামান রোকন পেয়েছেন সরকারের ঘর। অনুমোদিত তালিকায় রয়েছে ব্যাপক গড়মিল। এক ইউনিয়নে নাম থাকলেও ঘর গেছে অন্য ইউনিয়নে। আমির আলী, সাহেরা বানু, অক্কর আলীর নাম কচাকাটা ইউনিয়নে থাকলেও তা গেঝে বল্লভের খাষ ইউনিয়নে।এ প্রসঙ্গে বল্লভেরখাস ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সাইফুর রহমান জানান, তালিকায় আমাদের কোন হাত নেই, আমরা তহসিলদারদের ভাগ থেকে দু’একটা নাম নিয়েছি।
রায়গঞ্জ ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশী অনিয়ম হয়েছে বলে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেল বাকী মাসুম। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে আমরা সদস্য থাকলেও কোন কিছু আমরা জানিনা। সব কিছুই করেছেন প্রকল্প সভাপতি ইউএনও। তালিকা প্রস্তুতে অনিয়মসহ নির্মাণে রয়েছে অনিয়ম। তিনি আরো বলেন, একটি ঘর নির্মাণে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে অথচ সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১ লাখ টাকা।
উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, আশ্রয়ন-২ ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ সামগ্রী সাবেক ওএস জিল্লুর রহমান নিজে সরবরাহ করছেন। সবকিছু অত্যন্ত নি¤œমানের দিয়েছেন। এছাড়াও চেয়ারম্যানের দেয়া তালিকার নাম পরিবর্তন করে অর্থের বিনিময়ে সুবিধাভোগী তালিকাভুক্ত করার অভিযোগও করেন জনপ্রতিনিধিরা।
প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার রায়। তিনি জানান, উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দিক ম্যানেজ করে চলতেই কিছুটা অনিয়ম হয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এ উপজেলায় ৬৫১টি ঘরের বিপরিতে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি ঘরের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ টাকা। ঘর নির্মাণ শেষে বাড়তি টাকা সুবিধাভোগীদের ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি এ টাকা।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page