ঢাকার চেয়ে মফস্বল তথা গ্রাম এলাকার অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও নাজুক থাকার পরও গ্রামের মানুষকেই সবচেয়ে উচ্চহারে টাকা গুনে বিদ্যুত্ ব্যবহার করতে হবে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের যে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে সেটি বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার কার্যকর হবে।
বিদ্যমান এবং নতুন মূল্যহার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব সংস্থা বা কোম্পানির গ্রাহক নির্বিশেষ বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এই হার সর্বোচ্চ আট দশমিক ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বিতরনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটি দামবৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার। অথচ ঢাকায় বিদ্যুত্ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সবচেয়ে কম দাম বেড়েছে। ডিপিডিসির গ্রাহকদের বিদ্যুতের মূল্য সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ডেসকোর গ্রাহকদের সর্বোচ্চ এক দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে।
গত বৃহস্পতিবারের ঘোষণা নিয়ে গত আট বছরে বিদ্যুতের দাম আট দফা বাড়ানো হলো। ২০০৯ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম যেখানে গড়ে আড়াই টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ৬ টাকা ৮৫ পয়সায় দাঁড়াচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের অর্থনীতি-ব্যবসা শহরের চেয়ে দুর্বল। তাই এতদিন ঢাকার চেয়ে গ্রামে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির হার কম ছিল। এবার সেটি সমান নয় বরং বেড়ে গেছে। গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সময়কাল নিয়েও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে গ্রামে।
বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, তেলভিত্তিক সেচপাম্প কমে বিদ্যুিভত্তিক সেচপাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। গত বোরো মৌসুমে ফলন কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতির শিকার হয়েছে। এবার ঠিক বোরো মৌসুম শুরুর আগে সেচের খরচ বাড়িয়ে দেয়া হলো। এটি সময়োপযোগী হয়নি। বর্তমানে এ শ্রেণীর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৮০ পয়সা হলেও ডিসেম্বর থেকে সেটি ৪ টাকা গুনতে হবে।
বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে সাত দশমিক ২১ শতাংশ হারে।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, গ্রামের গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা চিন্তা করেই আগে তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম ও দামবৃদ্ধির হার কম রাখা হতো। এবার অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করায় তারা বঞ্চিত হলো। এটি অন্যায্য।
বর্ধিত মূল্যহার অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ডিপিডিসি ও ডেসকোর আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়েনি বরং যথাক্রমে এক দশমিক ২৩ ও দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমেছে। যদিও ঢাকা শহরে প্রথম ধাপের বিদ্যুত্ গ্রাহক খুবই কম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ডিপিডিসির গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়েনি। অর্থাত্ ডিপিডিসির গ্রাহকদের ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বর্ধিত কোনো বিল দিতে হবে না। আগে যে পরিমাণ বিল দিত তা-ই দিতে হবে। আর ডেসকোর গ্রাহকদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে যথাক্রমে দশমিক ৩৭ ও দশমিক ৭১ শতাংশ।
এদিকে পিডিবি, আরইবি, ওজোপাডিকো ও নেসকোর গ্রাহকের বড় অংশই প্রথম ধাপের। এসব বিতরণ সংস্থার সরবরাহ করা বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ছয় দশমিক শূন্য তিন ও ছয় দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাত্ ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত গ্রামের গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ঢাকার ভোক্তাদের তুলনায় ৪-৫ গুণ।
চতুর্থ ধাপে বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে কম বেড়েছে ডিপিডিসির গ্রাহকদের। কোম্পানিটির গ্রাহকদের ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুত্ বিলের জন্য মাত্র দশমিক ৩৩ শতাংশ বর্ধিত দাম পরিশোধ করতে হবে। এ ধাপের ডেসকোর গ্রাহকদের জন্য বর্ধিত হার এক দশমিক ১৮ শতাংশ। পিডিবি, আরইবি, ওজোপাডিকো এবং নেসকোর চতুর্থ ধাপের গ্রাহকদেরকে গুনতে হবে ছয় দশমিক ৯৩ শতাংশ বর্ধিত দাম।
পঞ্চম ধাপে ডিপিডিসির গ্রাহকদের বর্ধিত বিল গুনতে হবে শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে। ডেসকোর গ্রাহকদের জন্য এ হার এক দশমিক ২০ শতাংশ। আর পিডিবি, আরইবি, ওজোপাডিকো ও নেসকোর গ্রাহকের পঞ্চম ধাপে গুনতে হবে ছয় দশমিক ৯০ শতাংশ বর্ধিত দাম। অর্থাত্ ৬০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুত্ ব্যবহারের জন্য ঢাকার গ্রাহকদের বিদ্যুত্ বিল তুলনামূলক অনেক কম আসবে। অথচ ঢাকার বাইরে এ হার কয়েক গুণ বেশি।
ষষ্ঠ ধাপে সবচেয়ে কম বিদ্যুত্ বিল বাড়বে ডেসকোর গ্রাহকদের। কোম্পানির গ্রাহকদের জন্য এ হার এক দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ডিপিডিসির গ্রাহকদের বর্ধিত বিল গুনতে হবে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে। এছাড়া পিডিবি, ওজোপাডিকো ও নেসকোর ষষ্ঠ ধাপের গ্রাহকের গুনতে হবে সাত দশমিক ২১ শতাংশ বর্ধিত দাম। কিন্তু আরইবির গ্রাহকদের গুনতে হবে আট দশমিক ২৩ শতাংশ বর্ধিত দাম।
গত বছর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘রাজনীতি, সুশাসন এবং মধ্যম আয়ের আকাঙ্খা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর একটি পরিবার প্রতি মাসে গড়ে ৫৫ হাজার ৮৬ টাকা আয় করে। গ্রামের একটি পরিবারের মাসিক আয় গড়ে ১৮ হাজার ৩৪৯ টাকা। আর অন্য শহরাঞ্চলের একটি পরিবারের আয় ২৪ হাজার ৩১ টাকা। দেশে একটি পরিবারের গড় মাসিক আয় ৩১ হাজার ৮৮৩ টাকা।
সবমিলিয়ে ঢাকার গ্রাহকদের আয় রাজধানীর বাইরের গ্রাহকদের আয়ের চেয়ে তিন গুণ বেশী। মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামীণ জনগণের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে কমছে বলে ওই গবেষণায় উঠে আসে।
বৃহস্পতিবার দাম বৃদ্ধির ঘোষণাকালে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, ২০১০ সাল থেকেই সবার জন্য সমান বিদ্যুত্ সুবিধা নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে। মানসম্পন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ বেশি হওয়ায় কিছু এলাকায় এর দামও কিছুটা বেশি রাখা হতো। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সেসব এলাকায় বিদ্যুত্ সরবরাহে লোকসানও বেশি হয়। এজন্য গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামে সমতা আনা হয়েছে।