ছয়-সাত বছর বয়সী দুই শিশু পাশাপাশি হাঁটছে। একজনের হাতে কয়েকটি রঙিন বেলুন, অন্যজনের হাতে তাজা ফুল। সেগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে তারা রাজধানীর ধানমন্ডি লেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের মধ্যে বেলুন হাতের মেয়েটি বলল, ‘আইজকা দেখি সব ঝিকঝিক করতাছে।’ অন্যজন বলল, ‘হ, বড় কেউ আইব মনে লয়।’ শিশুটির অনুমান মিথ্যা নয়। আজ সোমবার সকালে সেখানে যাচ্ছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। কিছু সময় তিনি হাঁটবেন সারি সারি গাছের সবুজ মায়ায় ঘেরা লেকের পাশের ওয়াকওয়েতে। এরপর যাবেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে। শ্রদ্ধা জানাবেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে।
মাখোঁর সফর উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে ধানমন্ডি লেকে চলেছে ব্যাপক কর্মতৎপরতা। ঘষেমেজে রীতিমতো নতুন সাজে সেজেছে এক টুকরো প্রশান্তির এই অঙ্গন। গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিপুলসংখ্যক কর্মী পুরো লেক এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। সড়কের কিছু অংশে ছোটখাটো সংস্কার চলছে। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে কিছু গাছের ডালপালা। লেকের পাড়ে ছিটানো হয়েছে ব্লিচিং পাউডার। আর মশা নিধনে ব্যবহৃত ফগার মেশিনের ধোঁয়ায় ভরে আছে চারপাশ।
এই কর্মযজ্ঞের তদারকি করছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আসগর। তিনি সমকালকে বলেন, ভিনদেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান আসছেন। তিনি এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটাবেন। এ কারণে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগ এই লেককে পরিচ্ছন্ন করছে। সম্মানিত অতিথির সামনে যেন দেশের মর্যাদা অটুট থাকে, সেজন্য সবকিছু ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে লেকে আসতে চাননি বলে শুনেছি। তাঁর ইচ্ছা, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকা অবস্থাতেই তিনি এখানে হাঁটবেন। তিনি হয়তো তাঁর উদার চিন্তা থেকেই তেমনটা বলেছেন। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়া তাঁর চলাফেরা ঠিক হবে কিনা, সেটি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি চলাকালে গতকাল ধানমন্ডি লেকে সময় কাটাতে যাওয়া প্রায় সবার মুখেই ছিল মাখোঁর সফর নিয়ে আলোচনা। লেকের ভেতরের এক চা দোকানি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বলছিলেন, প্রতিদিন ঠিকমতো পরিষ্কার করলে তো এক দিনে এত চাপ পড়ত না। আর সাধারণ মানুষও চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ পেত।
তাঁর কথার জবাবে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী আব্দুল হক জানান, লেকের পুরো এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে যতটা জনবল প্রয়োজন, ততটা নেই। এখন তিন-চার দিন ধরে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ কর্মী কাজ করছেন। গতকাল কাজ করেছেন প্রায় ৩০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। কিছু সময় পরপর ট্রাকে করে আবর্জনা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভালো করে ঝাড়ু দিয়ে লেকের পাশের রাস্তাসহ পুরো এলাকা পরিষ্কার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানালেন, সোমবার সকাল ৮টার দিকে ধানমন্ডির ৮ নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন প্রবেশপথ দিয়ে লেক এলাকায় ঢুকবেন মাখোঁ। এরপর হেঁটে তিনি যাবেন লেকের পাশেই ৩২ নম্বরে। শ্রদ্ধা নিবেদন ও জাদুঘর পরিদর্শন শেষে তিনি জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘জলের গান’-এর শিল্পী রাহুল আনন্দের বাসায় যাবেন। সেখানে তিনি শিল্পীর কণ্ঠে শুনবেন লোকসংগীত। তাঁর সফর উপলক্ষে রাহুলের বাসাতেও পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি চালিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা।
লেকের ওয়াকওয়ে ধরে এগোতে দেখা গেল, কিছু স্থানে সিমেন্ট-বালুর আস্তরণ লাগাচ্ছেন কর্মীরা। পথের দুই পাশে বসানো প্লাস্টিকের ডাস্টবিনগুলোও পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। কিছু স্থানে পড়ে আছে কেটে ফেলা গাছের ডালপালা। পরক্ষণে সেগুলো সরিয়ে ফেললেন কর্মীরা। সব মিলিয়ে যেন নতুন সাজে সেজেছে ধানমন্ডি লেক।
১৯৫৬ সালে লেকসহ ২৪০.৭৪ হেক্টর জমিতে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। পুরো এলাকার প্রায় ১৬ ভাগ জুড়ে রয়েছে এই লেক। এটি ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়ক থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। তিন কিলোমিটার দীর্ঘ লেকের দুই পাশে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। কংক্রিটের এই নগরে সবুজ স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পেতে অনেকেই এখানে ছুটে আসেন। জলঘেরা পরিবেশে ঝিরঝিরে হাওয়া ও পাখির কলতান জুড়িয়ে দেয় প্রাণ।