• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ অপরাহ্ন

বরখাস্ত শিক্ষকদের পুনর্বহাল করে কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা,

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষক-কর্মচারী বরখাস্ত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও ঢাকার শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে এ নিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। শিক্ষক কর্মচারীদের বরখাস্তের পর ফের বহাল করার নামে বাধ্য করা হয় মোটা অংকের টাকা দিতে। এমন ১৭ জন ভুক্তভোগীকে খুঁজে পেয়েছে ঢাকা টাইমস, যারা বরখাস্তের পর সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে আদালতের আদেশ নিয়ে বহাল হয়েছেন ওই কলেজে। এদের মধ্যে ৪ জন সিন্ডিকেটের বরখাস্ত বাণিজ্যের বিষয়ে ঢাকা টাইমসের কাছে খোলাখুলি বর্ণনা করেছেন।

প্রাপ্ত কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে মোহাম্মদ তানভীর আহমেদ নামে এক শিক্ষককে বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করে দেওয়া হয় বেতন-ভাতাও। কলেজ কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন প্রায় ৪ বছর। একপর্যায়ে কলেজের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের কথা মতো এই চার বছরে যে বেতন ভাতা আটকে আছে তার বড় একটি অংশ তাদের দিতে রাজি হন ওই শিক্ষক। এরপর চলতি বছর আদালতের আদেশে ওই শিক্ষক চাকরি ফিরে পান। পরে তার স্থগিত থাকা বেতন ভাতার ২৮ লাখ টাকা থেকে পান মাত্র ১২ লাখ টাকা। বাকি টাকা তুলে দিতে হয় সিন্ডিকেটের হাতে। এ টাকার ভাগ শিক্ষা বোর্ড থেকে শুরু করে ম্যানেজিং কমিটি, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা পেয়ে থাকেন বলেও জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৩ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বরখাস্ত হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন কামরুন নাহার আহমেদ। ক্ষমতায় আসীন হয়েই ২০০৪ সালে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. ফরিদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০০৭ সালে বরখাস্ত হন আরও আটজন শিক্ষক-কর্মচারী। তারা হলেন- মোস্তাক আহমেদ মারুফ (পরবর্তীতে অধ্যক্ষ), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো.বদরুল ইসলাম, জাকির আল মামুন, মুন্সি মোহাম্মদ শাহীন, সাহেরা খাতুন, ওয়াহেদ ভূঁইয়া ও শফিকুল ইসলাম ইউনুস। ফের দুই বছরের মাথায় ২০০৯ সালে আদালতের নির্দেশে তাদের স্বপদে বহাল করা হয়। এ দুই বছরে তাদের পাওনা ২ কোটি টাকা কলেজ তহবিল থেকে দেওয়া হয়। এর বড় একটি অংশ নিয়ে নেন বরখাস্ত বাণিজ্যে যুক্ত ব্যক্তিরা।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৫ সালে মো. আব্দুর রহমান অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের অনুগত না হলে ওইসব শিক্ষক-কর্মচারীদের নানা হয়রানি করা হয়। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বরখাস্ত করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বর্তমান অধ্যক্ষের রোষানলে পড়ে বরখাস্ত হয়েছেন- মোহাম্মদ তানভীর আহমেদ, মো. ফজলুর রহমান, মো. সাব্বির, রাজিয়া বেগম, মুন্সি মোহাম্মদ শাহীন, মোহাম্মাদ মাকসুদুর রহমান, মো. রিপন ফকির। বরখাস্তদের আবার স্বপদে পুনর্বহাল করে পাওনাদি ফিরিয়ে দেওয়ার নামে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।

২০১৮ সালে মোহাম্মদ তানভীর আহমেদ নামে এক শিক্ষককে কলেজের এক কর্মচারীকে যৌন হয়রানি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বেশিকিছু অভিযোগে বরখাস্ত করে তৎকালীন কলেজ পরিচালনা পরিষদ। কিন্তু ওই শিক্ষক বর্তমান অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রহমানের ছাত্র হওয়ায় তাকে শাস্তি না দিয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করে ‘নির্দোষ’ বানিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে।

তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। আমার কলেজে এমন কোনো ঘটনা নেই। এ কলেজে শিক্ষকদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। অকারণে কাউকে হয়রানি, বরখাস্ত করা হয় না। যারা অপরাধ করেছে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। আমার আমলে কোনো শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়নি। কাউকে বরখাস্ত করার পরে অভিযোগ যদি প্রমাণিত না হয়, সে আবার স্বপদে বহাল হয়। কাউকে বহাল করেও টাকা ভাগাভাগি করা হয়নি। শিক্ষক তানভীরের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত করে কিছু পাওয়া যায়নি। তাই তাকে বহাল করা হয়েছে।’

কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান অভিযোগ বলেন, ‘এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টার মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে প্রথমে কারণ দর্শানো ও পরে বরখাস্ত করা হয়। এটা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। কারণ দর্শানো ও বরখাস্ত করার চিঠিতে কোনো মিল নেই। চিঠিতেই প্রমাণ করে তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমাকে (মাকসুদুর) বরখাস্ত করেছে। অকারণে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে।’

ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা ও বরখাস্ত করার চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই চিঠির মধ্যে তথ্যের গরমিল রয়েছে। কারণ দর্শানোর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে- ছাত্রীকে আপনার বিভাগে ডেকে নিয়ে, কৌশলে বিভাগ জনশূন্য করে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। বরখাস্ত করা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে শ্লীলতাহানি, বিনা অনুমতিতে অন্য কলেজের ছাত্রীকে শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া এবং কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত করা হলো।

কারণ দর্শানোর নোটিশে শুধু ‘শ্লীলতাহানির চেষ্টার’ কথা বলা হলেও বরখাস্ত করা চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘শ্লীলতাহানি’। একইসঙ্গে আরও দুটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে- শিক্ষা সফরে অন্য ছাত্রীকে নিয়ে যাওয়া ও কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতার অভিযোগ। যা কারণ দর্শানোর চিঠিতে নেই।

শ্লীলহানিতার অভিযোগ দেওয়া ছাত্রীর বাবা আব্দুস সাত্তার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যেদিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সেদিন আমরা জানতে পারি নাই। পরে জেনেছি।’ ওই ছাত্রীর মা শাহানাজ সাত্তার বলেন, ‘তেমন বড় কিছু না। খারাপ ভাষায় বকা দিলে তো অভিযোগ দেবেই।’

বরখাস্ত হওয়া মোহাম্মদ তানভীর আহমেদের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য তাসলিমা বেগম বলেন, ‘তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমি সিদ্ধান্তটা দিয়েছিলাম যে তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হয়েছে তানভীর দোষী। যখন আমি চলে এসেছি তখন মেয়েটা নাকি অভিযোগ তুলে নিয়েছে। এতে তারা তাকে পুনর্বহাল করেছে। পাওনাদি বুঝিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা লিখিত অভিযোগ করে ফাঁদে ফেলল আবার অভিযোগ তুলে নিল। মেয়েটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? আর এখন যদি বলে তানভীরের তদন্ত সঠিক হয়নি। তাহলে আমাকে কেন জানানো হয়নি। আমি অধ্যক্ষকে ধরব।

তিনি বলেন, ‘শুনেছি এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের একটা সিন্ডিকেট আছে। শিক্ষকরা সিন্ডিকেট করে হয়রানি, বরখাস্ত খুবই দুঃখজনক, লজ্জাজনক। তবে অন্যায় করলে শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেট থাকলে প্রতিষ্ঠানের মান মর্যাদা থাকে না।’

সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন ভাইস-প্রিন্সিপাল আসমা পারভীন। বলেন, ‘আমাকে একটা প্রশ্নও করবেন না।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ