প্রশ্নপত্র ফাঁসের অব্যাহত প্রবণতা আমাদের জাতি গঠন ও আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনসহ সরকারী বেসরকারী সব কর্মক্ষেত্রে মেধাবীদের বঞ্চিত করে একশ্রেনীর দুর্নীতিবাজ মেধাহীন ব্যক্তি জায়গা করে নিচ্ছে। এমনিতেই নানা কিসিমের কোটার কারণে সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবীদের স্থান বেশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে অঘোষিতভাবে উপরি মহলের গোপন যোগসাজশ-স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি তো আছেই। একজন মেধাবী ছাত্র অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে পরিবারের স্বপ্ন পুরণ ও দেশ ও জাতির সেবার জন্য পাবলিক পরীক্ষা অর্থবা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। সেখানে মোটা অর্থের বিনিময়ে আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়ে তাদেরকে বঞ্চিত করে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই অকার্যকর ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন না হলেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি থেকে শুরু করে বিসিএসসহ সব নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনির্বায বাস্তবতা এখন পুরো জাতির জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষ, ভর্তি পরীক্ষা, সরকারী নিয়োগ পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ও তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে ইদানিং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বাইরেও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে সরকারীদলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং সরকার সমর্থিত শিক্ষক কর্মকতাদের জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ এ সপ্তাহে(২০ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গোয়েন্দাদের হাতে আটক হয়েছেন কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। মাঠ পর্যায়ে যারাই থাকুক, এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নেতৃস্থানীয় শিক্ষকদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সরকার সমর্থিত শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন অসহায়। প্রায় প্রতিটি প্রশ্নফাঁসের ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সত্য আড়াল করে অথবা অস্বীকার করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও একসময় এমনিতেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। এরপরও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাবদিহিতা ও কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছেনা। এভাবেই প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে মেধাহীন ও দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বছরের পর বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনের পরও মেধাবিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অথবা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারার ব্যর্থতার হতাশা পুরো জাতিকেই আক্রান্ত করছে। এমনিতেই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে শিক্ষাবাণিজ্য একটি মারাত্মক ব্যাধির মত সমাজদেহে বিস্তারলাভ করেছে। একেকটি নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারকে তাদের আয়ের বড় অংশই সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করতে হয়। তথাকথিত নামি দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার টাকা ভর্তি ফি, গোপন ডোনেশন ছাড়াও ভর্তি কোচিং সারা বছর বেতন ছাড়াও স্পেশাল কোচিং, গাইডবই, নোটবই ইত্যাদি নানা পন্থায় শিক্ষাবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হলেও প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকেই ভর্তিবাণিজ্য ও শিক্ষাবাণিজ্যের রমরমা বাণিজ্য চলছে প্রকাশ্যেই। সরকারী প্রশাসন ও মন্ত্রী,এমপি-আমলাদের ম্যানেজ করেই দেশব্যাপী অনৈতিক শিক্ষাবাণিজ্য চলছে। নিচের স্তর থেকে এবং তথাকথিত নামি-দামি স্কুল-কলেজ ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব। বিশ্বের আর কোথাও পাবলিক পরীক্ষায় এমন প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি, বাণিজ্য, দলবাজির অপরিনামদর্শি তৎপরতা চলেনা। দেশের প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দুনীর্তির প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও পাবলিক সেক্টরে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানাভাবে মেধাবীদের বঞ্চিত করে দুর্নীতিমূলকভাবে মেধাহীনদের জায়গা করে দিয়ে দেশ থেকে মেধা পাচার ও দেশের মানুষকে সেবাবঞ্চিত করার এ প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হতে হব আমরা। মানব সম্পদ জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জাতির মেধাবি ও সম্ভাবনাময় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপযুক্ত পদ থেকে বঞ্চিত করে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে জাতি হিসেবে এগিয়ে থাকা সম্ভব নয়।