পাবনা জেলা প্রতিনিধি॥
বৃহত্তর পাবনা (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা) অঞ্চলের রাউতারা বাথানের গরু থেকে আয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রায় দেড় লাখ পরিবার এখন স্বাবলম্বী। এসব বাথান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ লিটার খাঁটি তরল দুধ। এই দুধ সরবরাহ করা হয় বাঘাবাড়ী মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটায় দুধ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে এ অঞ্চলের গোখামারী ও চাষিরা।
স্বাধীনতার পর পাবনা-সিরাজগঞ্জের দুগ্ধ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদী পাড়ে স্থাপন করা হয় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা। এর আওতায় ৩৫০টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি রয়েছে। সমিতিতে গো-খামার রয়েছে প্রায় ১২ সহস্্রাধিক। এসব সমিতি প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া দু’টি জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ব্যাক্তি পর্যায় গাভী পালন করা হয়। এসব গাভী থেকে আরো প্রায় দেড় লাখ থেকে সোয়া লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। এই দুগ্ধ অঞ্চলকে টার্গেট করে প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্রাক ফুড (আড়ং), আমো ফ্রেস মিল্ক, কোয়ালিটি, বিক্রমপুরীসহ বেশ কিছু বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে এ অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে।
শতাব্দীর প্রাচীনকাল থেকে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের চাষিরা উন্নতজাতের পাক-ভারতের জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফএস, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও মুলতানি গরু লালন-পালন করে আসছে। এ অঞ্চলের গো-সম্পদের ভবিষ্যৎ এবং গোসম্পদকে অর্থকরী সম্পদে রুপ দিতে স্বাধীনতার পর বাঘাবাড়ীতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা করখানা স্থাপন করা হয়।
প্রাণ ডেয়ারির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক শরিফ উদ্দিন তরফদার জানান, সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারীদের কাছ থেকে চার দশমিক শুন্য স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩ টাকায় কিনে সেই দুধ থেকে ননী বেড় করে নিচ্ছে। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ প্যকেটজাত করে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি করছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ টাকা লিটার। প্রতি লিটার দুধ থেকে শুন্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননী তুলে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটার দুধে লাভ হচ্ছে ১৫ টাকা। এছাড়া এক লিটার দুধ থেকে ৩২ টাকার প্রায় ৪০ গ্রাম ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে আয় করছে ৯০ টাকা। এতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা প্রতি লিটার দুধে প্রায় ৪৭ টাকা লাভ করছে। অপরদিকে খামারীরা প্রতি লিটার দুধের দাম পাঁচ থেকে সাত টাকা বৃদ্ধির দাবি করে আসছে। কিন্তু তাদের সে দাবি পুরন হচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, পাবনা অঞ্চলের বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলায় ৪০০টি বাথানে প্রায় পাঁচ হাজার একর গোচারন ভূমি রয়েছ্।ে জাল দলিল ও ভূয়া পত্তনি নিয়ে এলাকার একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বেশ কিছু গোচারন ভূমি আত্মসাৎ করেছে। অপরদিকে ব্যক্তিমালিকানাধিন গোচারণ ভূমির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার একর। বাথান এলাকায় জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফএস, শাহিওয়াল, অস্ট্রেলিয়ান ও সিন্ধিসহ হরেক জাতের শঙ্কর গাভী রয়েছে। পৌষ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস (ছয় মাস) পর্যন্ত গবাদিপশু বাথাণ এলাকায় অবস্থান করে। বানের পানি গোচারণ ভূমি থেকে নেমে যাওয়ার পর আবাদকৃত ঘাস খাওয়ার উপযোগী হলেই গবাদিপশু বাথানে নেয়া হয়। বাথান এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে বাঁশের ঘেরা দিয়ে গরুগুলো রাখা হয়। তবে বকনা, ও থারি, ষাঁড় এবং বাছুরগুলোর জন্য পাশাপাশি রয়েছে আলাদা ঘেরার ব্যবস্থা। বিস্তীর্ণ গোচারন ভূমিতে চরে বেড়ানোর পর বিকেলে এরা ঘেরায় ফিরে আসে। গবাদিপশুর খৈল-ভূসি ও রাখালদের থাকার জন্য রয়েছে খড়ের তৈরি ঘর। প্রায় ছয় মাস রাখলদের থাকতে হয় এখানে।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামের গবাদিপশুর খামারি হারান ঘোষের সাথে কথা বলে জানা যায়, একক মালিকানায় বাথানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পাঁচ থেকে ১৫ জন মিলে একত্রে একটি বাথানে আয়তন ভেদে ২০০ থেকে ৭০০ গরু রাখা হয়। এসব মালিকের প্রায় প্রতিদিনই একবার করে বাথানে যেতে হয় খোঁজ খবর নিতে। তবে তাদের বেশিরভাগ সময় কাটে খৈল-ভূসি-লালি সরবরাহ দুধের দাম ইত্যাদি সংগ্রহ করে। বাথান মালিকদের নিয়োজিত রাখালরা সার্বক্ষনিক বাথানে অবস্থান করে। পুরোপুরি এদের ওপরই নির্ভর করতে হয় গরুর মালিকদের। বাথানে প্রতিদিন সকাল ও বিকাল মিলে প্রায় আড়াই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ হয়। এই দুধ বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা কারখানায় সরবরাহ করা হয়।
এদিকে সরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা এবং প্রায় ২০টি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিত দুধ ক্রয় করায় এ অঞ্চলের হাজার হাজার খামারী ও চাষি উৎপাদিত দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তবে তারা ন্যায্য মূল্য পেলে আরো লাভবান হবেন বলে জানান।