এমন পরিস্থিতির শিকার আগে হয়েছি বলে অভিজ্ঞতাটা নতুন নয়। পত্রিকায় প্রশ্ন ফাঁসের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আমার মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছে, প্রশ্ন ফাঁস কারা করে? সেখানে আবার লেখা ছিল, শিক্ষকরাই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত! এ নিয়েও আমাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে? রিসার মৃত্যুর পর পত্রিকা খুলেই আমার মেয়ের প্রশ্ন ছিল- স্কুলে যাওয়ার পথে মেয়েটিকে কে বা কেন মারল?
আমি অনেক কষ্টে এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। তাকে বোঝাতে হয়েছে দুর্নীতি আর নীতির পার্থক্য। আগের দিনে নীতি দিয়ে উদাহরণ টেনে বোঝানো হতো দুর্নীতি আর নীতির পার্থক্য, আর এখন ঠিক তার উল্টোটি! ছোটবেলায় দেখতাম মা-বাবা আমাদের সামনে তাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা করত না। প্রেম কথাটাও অনেক লজ্জার বিষয় ছিল। এখনও কিছু কিছু জিনিস মানুষ সন্তানদের কাছ থেকে আড়ালে রাখে আর সেগুলোকে লজ্জার বিষয় হিসেবে ধরা হয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন পত্রিকার গন্ধ নিয়ে পড়তে শুরু করা আমিই আমার সন্তানকে শিখিয়েছিলাম। বাসে তরুণী ধর্ষণের খবরটি ছাপা হয়েছে সেদিন। আমার মেয়ে ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা হাতে নেবে এবং যথারীতি এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে ভেবে ঠিক করে রেখেছিলাম, সকালে সবার ওঠার আগে পত্রিকা লুকোতে হবে! কী আশ্চর্য, যে পত্রিকা বিশ্বকে জানার দরজা, সেই পত্রিকা এখন লুকোনোর জিনিস হয়ে যাচ্ছে! শুধু শিশুরাই নয়, বড় যে কোনো মানুষ যদি ঘুম থেকে উঠে ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে তরুণীকে মেরে ফেলার সংবাদ দেখে, তাহলে সে আর নিজেকে স্বাভাবিক মানুষ ভাবতে পারবে না।
তবে কি সত্যিই আমরা অমানবিক হতে চলেছি? যদি বিদ্যার মাধ্যমকে লুকিয়ে রাখা শিখতে হয়, তবে যে দহন মনে সৃষ্টি হয়, তা কি বোধের দেয়ালকে একটুও ক্ষত-বিক্ষত করে না? একটি করে দিন যাচ্ছে আর মানবতা যেন শেকড়সহ উপড়ে পড়ছে আমাদের চোখের সামনে। তবে কি বিচারহীনতার সংস্কৃতির ওপরই এর দায় গিয়ে পড়বে?
বিচারহীনতাকে বেশি দায়ী করবেন নাকি অনৈতিকতাকে? আমি সত্যিই আমার শিশুর সামনে থেকে সংবাদপত্র কেড়ে নিতে চাই না। তাকে বলতে চাই, এ পৃথিবীর সব মানুষই ভালো। আমি শেখাতে চাই, অপরাধ যারা করে তারা মানুষ নয়, অন্য কোনো জাতবিশেষ। কিন্তু কী করে তা সম্ভব? শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নামের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে সন্তানকে তাদের ইতিহাস জানাই। কিন্তু পরমুহূর্তেই মিয়ানমারের ঘটনা দেখে যদি সে জিজ্ঞেস করে, বাবা এই সু চিই কি নোবেল পেয়েছিলেন শান্তিতে, তখন তাকে কী জবাব দিলে সঠিক উত্তর দেয়া হবে?
সন্তানের দেয়া শিক্ষা এবং আমাদের আচরণের ফারাক অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। সমাজের অনৈতিক চরিত্রগুলো যত বাড়বে ততই এ ফারাক আর পলায়নপরতা বাড়বে। এ থেকে বের হতে হলে অপরাধের বিচার দ্রুত ও নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রকেই নিতে হবে এ দায়িত্ব। প্রতিটি সকালকে শিশুদের সামনে একটি সুন্দর সকাল হিসেবে দিতে চাইলে নৈতিক অবক্ষয়গুলো বন্ধে দ্রুত কাজ করতে হবে। আসুন সভ্যতার পথে নিজেরাই নামি। আর রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ, প্রমাণিত অপরাধের বিচার যেন এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়।
সাঈদ চৌধুরী : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর

Share Button