সম্পাদকীয় | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 525 বার

দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশাই চোখে পড়ে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আবার বিপরীতভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এই মানুষের দ্বারাই আবার সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ ও অনিয়ম।
দেশে শিশু ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনা এখন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী থাকা সত্ত্বেও কেন এত নারী ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটছে? অপহরণ করে বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঢাকায় কিশোর গ্যাং দলের বিস্তার ও তাদের অপকর্ম থেকে আমরা কী শিক্ষা পেলাম? সম্প্রতি বগুড়ায় কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ অতঃপর মা ও মেয়েকে নির্যাতন ও মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনাও জাতিকে দেখতে হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ কত পাশবিক ও নৃশংস হলে চার- পাঁচ বছরের শিশুকেও এদেশে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর ফলে যে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তা কি নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসেই শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২৩ জন নারী ও শিশু। আর গত সাত মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫২৬টি। আমরা নির্যাতনের নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করতে ওস্তাদ! এখন চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, নিজের ঘরে গৃহবধূও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, প্রায়ই রাস্তাঘাটে নারী শিক্ষার্থীরা শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছে। এখন পায়ুপথে হাওয়া ঢুকিয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। দিনের পর দিন কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। স্কুলের কিশোরীরাও হরহামেশাই ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে পথে-প্রান্তে। মাদক বিশেষ করে ইয়াবার প্রভাব বিস্তার কিছু তরুণকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। গত ৪ আগস্ট ঢাকার বনশ্রীতে এক গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় সেখানে নাজেহাল কাণ্ড ঘটেছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তরুণদের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটে। মূলত এসব ঘটনা সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতারই চিত্র তুলে ধরে। বলতে গেলে কত ঘটনা আজ আমরা পত্রিকার পাতায় দেখি, না জানি এর চেয়ে কত বেশি ঘটনা ঘটে চলেছে!
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পেশিশক্তির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এর ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বিরাজ করছে। জবাবদিহিতার চর্চা নেই বললেই চলে। সহজ কথায়, আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলেছি। কবি শামসুর রাহমানের সেই কাব্যগ্রন্থের কথা মনে পড়ে। সত্যিই ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। কিন্তু কেন মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতার মতো ঘটনা প্রতিদিন ঘটে চলেছে? আমরা কি নির্যাতনকারীদের ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছি? প্রভাবশালী ক্যাডাররা কেন নৃশংস অপরাধ করে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে? এদেশের ২৬ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার। তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নইলে পেটের দায়ে যে কেউ যেকোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রান্তিক এলাকার মানুষেরা কি উন্নয়নের ছোঁয়া পাচ্ছে?
আমাদের পারিবারিক বন্ধনের জায়গাগুলো দিন দিন ভেঙে পড়ছে। পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষায় যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এখনকার তরুণ সমাজ কিংবা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে মনে হয়। তবে পরিহাস করে বলতে হয়, বেশিরভাগ তরুণ এখন বুক বা বই একটা পড়ছে আর সেটা হচ্ছে ‘ফেসবুক’! প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা এখন আর মাঠে খেলা করতে যাই না, পার্কে বিনোদনের জন্য যাই না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাই না কিংবা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করি না। এখন সব ফেসবুকেই সেরে ফেলছি! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখালেখিতে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে গেছেন। তিনি যন্ত্রকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন কিন্তু যান্ত্রিক জীবনকে ঘৃণা করেছেন। দেশে এত ভূরি ভূরি সংগঠন ও অঙ্গসংগঠন আগে কখনো ছিল না। প্রায় সব ক্ষেত্রে ও সব প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খানের একটি কথা এখানে মনে পড়ছে। তাঁর কথায়, ‘এদেশে খারাপ কাজের শাস্তি নেই, আর ভালো কাজের মূল্যায়ন নেই।’ আমার মতে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতার মতো ঘটনার রেশ টানতে হলে কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। যথা-১. শিশু ও নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে। ২. পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ এবং সবার মাঝে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করা। ৩. ধনী-গরিবের বৈষম্য কমানো এবং বেকারত্ব দূর করতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ৪. বই পড়ার অভ্যাস, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করা। ৫. নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা।
n লেখক : শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Leave a Reply