রেলওয়েতে গত অর্থবছরে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা ‘লোকসান’ হয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, রেল সেবা খাত, এখানে আয়-ব্যয় মুখ্য নয়। রেলে ‘লোকসান’ হচ্ছে এমনটি অযৌক্তিক। বরং রেলওয়েতে প্রতি বছরই আয় বাড়ছে। ব্যাপক উন্নয়ন যেমন হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে সেবাও। রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের ব্যয় রেলওয়ে থেকেই পরিশোধ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধও রেলওয়ে থেকে করা হয়। এসব ব্যয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই করার কথা, কিন্তু করতে হচ্ছে রেলওয়ে থেকে। প্রতি বছর প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে।

এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের আয় বাড়াতে ৫ বছরে দু’দফা রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতি বছর এক কিংবা দু’বার ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। যার ফলে আয় বাড়লেও তার সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেলের আয় হয় ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে ব্যয় হয় ২ হাজার ৫৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১ হাজার ২২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ বিষয়ে রেলওয়ে অপারেশন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তারা বলছেন, গত অর্থবছরে আয় বেড়েছে। ব্যয় বেড়েছে কিনা তা তারা জানেন না। তারা শুধু আয় করছেন, ব্যয় করছেন না। আয়ের পুরো টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, রেলওয়েতে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে, সঙ্গে সেবাও বাড়ছে। বাড়ছে আয়ও। রেল সেবা খাত, এখানে সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করাই তাদের চ্যালেঞ্জ। ট্রেন চলাচল কখনও বন্ধ থাকে না। যাত্রী কম বা বেশি, ট্রেন চালাতেই হয়। তিনি বলেন, রেলওয়ের আয়ের টাকা পুরো সরকারের খাতে চলে যায়। এ টাকা থেকে সরকার আমাদের আয়-ব্যয় করতে দেয়নি। আমরা সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্রেন চালাচ্ছি। জনগণের সার্ভিস আমরা দিচ্ছি। পলিসি নির্ধারণও সরকার করছে। বরং আমরা বিভিন্ন খাত যেমন- রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করছি। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধও আমাদের করতে হচ্ছে। এসব ব্যয় রেলওয়ে থেকে করার কথা নয়। নিজ নিজ মন্ত্রণালয় থেকে করার কথা। এসব মিলিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া নতুন পে-স্কেল কার্যকর হওয়ায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শুধু বেতন-ভাতা খাতেই প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের আয় বাড়াতে চলতি বছরের জুনে আবারও ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়, যা সম্প্রতি ফেরত দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়গায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে শপিংল মল, পাঁচ তারকা হোটেলসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে রেলওয়ে হাসপাতালগুলো বেসরকারিভাবে পরিচালনারও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। স্বল্পমূল্যে ট্রেন পরিচালনায় বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চালুর প্রস্তাবিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৫৮ কোটি টাকা। ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন নির্মাণ’ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।

জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ২২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে লোকসান হয় ১ হাজার ২০৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় ছিল ৯৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৮২৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে রেলের লোকসান হয় ৮৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে যাত্রী পরিবহন খাতে রেলের আয় হয় ৭৮৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর পণ্য পরিবহনে আয় হয় ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

এদিকে রেলওয়ে বাণিজ্যিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ের এক একটি ট্রেন উদ্বোধনের সময় ১৬ থেকে ১৮টি যাত্রীবাহী বগি নিয়ে চলাচল শুরু করলেও বর্তমানে ওই সব ট্রেনের কোনোটিতে ৮টি আবার কোনোটিতে ১০ থেকে ১২টি যাত্রীবাহী বগি রয়েছে। প্রায় সবক’টি ট্রেন নির্ধারিত যাত্রীবাহী বগির চেয়ে কম বগি নিয়ে চলাচল করছে। যদি নির্ধারিত বগি নিয়ে ট্রেনগুলো চলাচল করত তাহলে খরচ না বাড়লেও আয় বাড়ত। এছাড়া ট্রেনের টার্ন অ্যারাউন্ড বাড়িয়ে ট্রিপ বৃদ্ধি করা সম্ভব, যা ট্রেনের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বাণিজ্যিক বিভাগ আরও জানান, গত অর্থবছরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে ৭২৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং পশ্চিমাঞ্চল থেকে ৪৭৮ কোটি ১১ লাখ টাকা আয় হয়। তার আগের অর্থবছরে পূর্বাঞ্চলে ৫৯৪ কোটি ৩৭ লাখ এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩৩৬ কোটি ৫ লাখ টাকা আয়। অর্থাৎ প্রতি বছর আয় বাড়লেও লোকসান বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

Share Button