• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

লাগামহীন চালের বাজার

আল ইসলাম কায়েদ
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

দাম আরও বাড়ার শঙ্কা ব্যবসায়ীদের : শুল্ক কমানোর প্রভাব নেই বাজারে : মিল মালিকদের কারসাজি -বাণিজ্যমন্ত্রী
শুল্ক কমানোর পরও কমছে না চালের দাম। উল্টো বেড়েই চলেছে। দীর্ঘদিন থেকেই বাজার অস্থির। চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের উপর। বিশেষ করে বাড়তি টাকায় চাল কিনতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস উঠছে নিন্মবিত্তদের। আর ঈদের পর থেকে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। বলা যায় চালের বাজার এখন একেবারে লাগামহীন। চালের মজুত এখন নাজুক পর্যায়ে আছে। খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামে যেখানে ন্যূনতম ছয় লাখ টন চাল থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র সোয়া তিন লাখ টন। সরকার বিভিন্ন চালকলে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। যদিও সরকারের চাল সংগ্রহে নানা উদ্যোগ কোনভাবেই কাজে আসছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম আরও বাড়বে। দেশের চালকল মালিক ও কয়েকটি দেশের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করেও খাদ্য মন্ত্রণালয় মজুত বাড়াতে পারেনি। এদিকে ঈদের আগে ও পরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা। অপরদিকে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে চাল রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। আর তাই চালের দামের এই অস্থিরতা শিগগির কাটছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চালের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনরকম হা-হুতাশ নেই বলে দাবি করেছেন। যদিও এখন বলছেন, বাজার তদারকির দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। অপরদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, চাল নিয়ে মিল মালিকরা কারসাজি করছে। তাদের মজুতের কারণে চালে মাকড়সা ধরেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গোডাউনে গেছে। যারা অবৈধভাবে চাল মজুত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে চালের দাম সহনীয় পর্যায় রাখতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্ক কমানোর ফলে চালের আমদানি বেড়েছে; কিন্তু তা মূলত আতপ ও ভারতীয় মোটা চাল। সরু ও মাঝারি চাল আমদানি হচ্ছে কম। এর সুযোগ নিচ্ছে দেশের মিল মালিকেরা। পাশাপাশি আমদানিকারকদের কারসাজিতে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। তাদের মতে, চালের সংকট মোকাবিলায় ঈদের আগে সরকার দুই দফায় আমদানির শুল্ক কমিয়ে ২৮ থেকে ২ শতাংশে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি সরকার নিজেও বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রভাব চালের বাজারে পড়ার কথা। কিন্তু ইতিবাচক কোনো প্রভাব দেশের চালের বাজারে নেই। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে ধান-চাল সংগ্রহের কাজে খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। ফলে সরকারি খাদ্যগুদামে চালের মজুত না বাড়ায় দাম বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে চাল আমদানি শুল্ক কমানোর সুফল মিলছে না বাজারে। ভারত থেকে কম শুল্কে চাল আমদানি হলেও তেমন প্রভাব পড়েনি দামে। চাল আমদানিকারকদের অভিযোগ, বাংলাদেশে ঘাটতির সুযোগ নিয়ে চালের দাম টন প্রতি ৬০ ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে আমদানি শুল্ক কমানোর সুফল মিলছে না বাজারে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলছেন, চাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হলেও, আশঙ্কা রয়েছে তা অপব্যবহারের। তার মতে, এতে চালের দাম আর কমবে না, বরং নিম্নমানের চাল আমদানির মাধ্যমে লাভবান হবে ব্যবসায়ীরা। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাংলার কৃষক।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সরকারের অক্ষমতাকে ব্যবসায়ীরা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁরা লাভের জন্য যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, সরকারের গুদামে চাল কমে যাওয়ার খবরে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। সরকার চালের জন্য কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে সরকারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা নেই। যত দিন সরকারের চালের মজুদ ১০ থেকে ১২ লাখ টন না হবে, তত দিন পর্যন্ত অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতেই থাকবেন।
রাজধানীর কাওরান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা মিনিকেট চাল ৩০০০ টাকা, নাজিরশাইল ৩৪০০ থেকে ৩৭০০ টাকা, আটাশ ২৫০০ থেকে ২৬০০, স্বর্ণা ও ভারত থেকে আসা মোটা চালের বস্তা ২২৫০ থেকে ২৩০০, পারিজা ২৪০০ এবং পাইজাম চালের বস্তা ২৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের পরে এই বাজারে এসব চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। চালের খুচরা বিক্রেতা আব্দুল হক জানান, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম। আগামীকাল কেজিতে ১ টাকা বাড়বে। কেন চালের দাম বাড়ছে জানতে চাইলে আব্দুল হক বলেন, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়াচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকায় সরু চাল কেজিপ্রতি ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা, সাধারণ মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, উত্তম মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, সাধারণ মানের পাইজাম ও লতা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা, উত্তম মানের পাইজাম ও লতা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, স্বর্ণা ও চায়না ইরি চাল প্রতিকেজি ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়।
সংস্থাটির তথ্যমতে, সপ্তাহের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। এছাড়া সাধারণ মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৩.৪৪, উত্তম মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৮.৩৩, সাধারণ মানের পাইজাম ও লতা চাল ৮.৩৩, উত্তম মানের পাইজাম ও লতা চাল ৪.১৬, স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম বেড়েছে ৪ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) ১ জুলাই থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭৪ দশমিক ৮৫ হাজার টন। যেখানে গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার টন। সে হিসেবে এই দুই মাসের কিছু বেশি সময়ে গত অর্থবছরের প্রায় ৬ গুণ পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ১১ সেপ্টেম্বরের বাজার দরে দেখা গেছে, মোটা চালের বর্তমান বাজার দর পাইকারি প্রতি কেজির দাম ৪৩ থেকে ৪৪ এবং খুচরা মূল্য ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। যদিও কোরবানি ঈদের আগেই পাইকারি বাজারে এই চালের দাম চিলো ৪১ থেকে ৪২ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি করতো ৪৪ টাকা থেকে ৪৫ টাকা।
মিল মালিকদের কথামতে, দুই দফা বন্যার কারণে ধান নষ্ট হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বাড়তি। আমরা যারা খুচরা চাল বিক্রি করি। খুব সীমিত লাভ করে থাকি। কেজিতে দুই/এক টাকার বেশি আমাদের লাভ থাকে না। আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আরেক খুচরা বিক্রেতা ফারুক বলেন, এখন মোটা চাল কেজি প্রতি বিক্রি ৫০ টাকা, মিনিকেট ৬০ টাকা এবং নাজিরশাইল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সামনে চালের দাম আরো বাড়বে বলে জানান তিনি। ফারুক বলেন, যে পরিমাণ চাল পাবার কথা সে পরিমাণ চাল আমরা পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা এবং মিনিকেটের কেজি ৭০ টাকা হবে। আগামী বৈশাখ মাসে নতুন ধান উঠলে চালের দাম কমে আসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে কাওরান বাজারে চাল কিনতে আসা বাদশা মিয়া জানান, দুই দিন আগে যে চাল কিনেছেন ৫৭ টাকায় এখন তা ৬০ টাকা। অভিমানের সুরে বাদশা বলেন, কারে কি বলবো। বাজারে চালের আড়তে কোথাও তো চালের সরবরাহ কম দেখছি না। এই যে বাজারে এত চাল। এগুলো আসছে কোথা থেকে। তাহলে সংকটটা কোথায়? কেন চালের দাম এভাবে বাড়ছে। কেউ কি দেখার নেই? তিনি বরেন, আমরা বাঙালি আমাদের তো ভাত খেতেই হবে। চালের দাম বাড়ুক আর কমুক। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায় ব্যবসায়ীরা। সরকারের উচিত চালের বাজারটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। যাতে কেউ চাল নিয়ে চালবাজি করতে না পারে।
বাংলাদেশ চাল ব্যবসায়ী সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসাইন রনি বলেন, এতদিন শুল্ক বেশি ছিল বলেই ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করেনি। এখন যেহেতু শুল্ক কমানো হয়েছে সবাই কমবেশি আমদানি করবে। ইতিমধ্যে কিছু চাল এসেছে। কিছু পথে আছে। আরো অর্ডার দেয়া হচ্ছে।
ঈদের আগে কেজিপ্রতি দুই-তিন টাকা কমলেও আবার বাড়ার কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, মজুদ কম হওয়া এবং বর্তমান রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকায় চালের চাহিদা বাড়বে মনে করেছেন অনেকে। একই সঙ্গে বাড়বে দাম। আর তাই চাল মজুদ রাখছে ব্যবসায়ীরা।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্লিপ্ততার সুযোগে মুনাফালোভীদের অপতৎপরতা বেড়ে গেছে। তারাই অবৈধ মওজুদ ও নানা অজুহাতে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। যা স্বল্প আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রাকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে। বিবিএস এর হিসাব বলছে গত দুই মাস ধরে বাড়ছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি। যার মূলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নতুন মুদ্রানীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একে অপরকে দোষারোপ সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে না। তাঁর মতে, বিভিন্ন চালকলে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে বাজার আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত বাজারে বড় আকারে ওএমএস চালু করা, নিজেদের মজুত বাড়ানো এবং বেসরকারি খাতে চাল আনতে সহায়তা করা।
এদিকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে চাল রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এ বিষয়ে ভারতীয় কাস্টমস বাংলাদেশকে একটি চিঠি দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি এখনও পুরোটা জানি না। এমনটা হলেও আমাদের বাজারে কোনও প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, আমি হাইকমিশনারকে টেলিফোন করেছিলাম, তিনি কক্সবাজার আছেন, ঢাকায় ফিরলে বিস্তারিত জেনে কথা বলবো।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, এভাবে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। বাজারে চালের অভাব নেই, যথেষ্ট মজুত আছে। এ ছাড়া আমাদের আমদানি খরচ মাত্র ২৪-২৫ টাকা। তাহলে চালের দাম কেন এত বাড়বে? তিনি বলেন, বাজার তদারকির দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এখন আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভাগীয় কমিশনারদের টেলিফোন করে তাঁদের তদারকি বাড়াতে এবং সক্রিয় হতে বলছি।

Share Button


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page