রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চামড়া শিল্পে খেলাপি ঋণের ছড়াছড়ি। অধিকাংশ গ্রাহক টাকা ফেরত দিচ্ছে না। গত ৫ বছরে সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক এ খাতে মোট ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ ঋণই খেলাপি হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। পুনঃতফসিল এবং নতুন ঋণ মিলে এবার কোরবানির ঈদে চামড়া কিনতে দুই ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর, নানা অব্যবস্থাপনা, ট্যানারি নেতাদের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ অনুমোদন ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার কারণে বিতরণকৃত ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বিতরণ করা প্রায় ৯৯ ভাগ ঋণই বকেয়া।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক গত ৫ বছরে চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ঋণ গেছে নিয়মিত চামড়া শিল্পে। বাকি ৫৮৩ কোটি টাকা গেছে কোরবানির চামড়া ক্রয়ে। এসব ঋণ মোট ১০ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৫৫৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ভুলুয়া ট্যানারি, আমিন ট্যানারি, কালাম ব্রাদার্স ট্যানারি এবং মোহাম্মদিয়া লেদারের কিছু টাকা বকেয়া থাকলেও লেনদেন নিয়মিত আছে। কিন্তু বাকি ৬ প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এসব ঋণ পুরোটাই এখন কু-ঋণে পরিণত হয়েছে। মেসার্স ভারসেজ সুজের কাছে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া রয়েছে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। একইভাবে গ্রেট ইস্টার্ন ট্যানারি ১ কোটি টাকা, এক্সিলেন্ট ফুটওয়্যার প্রায় ১০ কোটি টাকা, দেশমা সু ইন্ডাস্ট্রিজ প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি, এসএনজেট ফুটওয়্যার প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা এবং আনান ফুটওয়্যারের কাছে ব্যাংকের বকেয়া প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এসব ঋণ বর্তমানে খেলাপি হয়ে গেছে। এবার তিন প্রতিষ্ঠানকে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে এক প্রতিষ্ঠান আগের ঋণ পরিশোধ করে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। বরং সময় বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে আরও নতুন ঋণ নিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কর্পোরেট শাখার মহাব্যবস্থাপক (জিএম) স্বপন কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, তিনটি প্রতিষ্ঠান ভালো হওয়ায় তাদের এবারও প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঋণ পরিশোধে দুটি প্রতিষ্ঠানকে আরও এক বছর সময় দেয়া হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের অপর একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া পুরনো সব পার্টি খেলাপি। কেউ টাকা ফেরত দিচ্ছে না। সূত্র আরও জানায়, কোরবানির চামড়া কিনতে গত বছর তিনটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কর্পোরেট শাখা। এর মধ্যে ভুলুয়া ট্যানারি বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধ করেছে। তাই এবার প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। গত বছরের নেয়া আমিন ট্যানারি ২৫ কোটি ও কালাম ব্রাদার্স ট্যানারি ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠান দুটি আরও এক বছর সময় নিয়েছে। পাশাপাশি আরও ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংক ২০১৬ সাল পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছরই ৪ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ১৬৭ কোটি টাকা। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের মেয়াদ থাকলেও কেউ কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। বরং সময় বাড়িয়ে তা নতুন ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া পুরনো খেলাপি আছে ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে হোসেন ব্রাদার্স ২৭ কোটি ২০ লাখ, মাইজদী ট্যানারি ২৪ কোটি, এফ কে লেদার ৫১ কোটি ও মিজান ট্রেডার্সের খেলাপি ৩২ কোটি টাকা। এসব ঋণ ১৯৮৫ সাল থেকে খেলাপি হয়ে আসছে। তবে এবার তিনটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানকে মন্দের ভালো বিবেচনায় নিয়ে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সামিনা ট্যানারি ৫৫ কোটি টাকা, বেঙ্গল লেদার ৬৫ কোটি টাকা ও এইচএনএইচ লেদার অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজকে দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ১৩৫ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করা হয়েছে। এছাড়া এবার তিন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকে এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ২৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। তবে এবার কোরবানির ঈদে কোনো ঋণ দেয়া হয়নি। আগের দেয়া সব ঋণই নিয়মিত আছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ যুগান্তরকে বলেন, এবারের কোরবানির ঈদে চামড়া খাতে নতুন কোনো ঋণ দেয়া হয়নি। আগের দেয়া ঋণ নিয়মিত আছে বলে জানান তিনি।