জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 253 বার

মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গারা প্রাণ হারানোর ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে খাদ্য, বস্ত্র, বিশুদ্ধ পানি ও বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী যমুনা গ্রুপ।
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে শুক্রবার ৮০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে ত্রাণের প্যাকেট বিতরণ করা হয়।
যমুনা গ্রুপের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের দেয়া ত্রাণের প্যাকেটে চাল, ডাল, তেল, গুঁড়া দুধ, মুড়ি, বিশুদ্ধ পানির বোতল ও খাবার স্যালাইন ছিল। সকালে জেলা প্রশাসকের হাতে ত্রাণসামগ্রী বুঝিয়ে দেয়া হয়।
এরপর বিকালে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণ বিতরণের খবর পেয়ে আগে থেকেই শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা লাইন দিয়ে বসে থাকেন। অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে খোলা স্থানে হুড়াহুড়ি ছাড়াই রোহিঙ্গাদের হাতে ত্রাণ তুলে দেয়া হয়। ত্রাণের বাকি অংশ আজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হবে।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন দাদা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও যমুনা গ্রুপের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ। তার সঙ্গে ছিলেন যমুনা গ্রুপের পরিচালক সারীয়াত তাসরিন সোনিয়া, যমুনা গ্রুপের পরিচালক মেহনাজ ইসলাম, এমকাবা লিমিটেডের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল প্রমুখ।
এর আগে সকালে কক্সবাজারের হোটেল কক্স টুডেতে যমুনা গ্রুপ একটি সেমিনারের আয়োজন করে।
‘মানবিক দিক থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক সেমিনারে জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা এবং বিশিষ্টজনরা অংশ নেন। যমুনা টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ জামশেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন যমুনা ইলেকট্রনিক্স ও অটোমোবাইলের হেড অব বিজনেস সাজ্জাদুল ইসলাম।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে নয়, মানবিক দিক বিবেচনা করে দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে রোহিঙ্গারা বেঁচে থাকতে পারবেন। প্রতিটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান-শিল্প গ্রুপ যদি এক সপ্তাহের খাবার-রসদ জোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে বছরব্যাপী ত্রাণ কার্যক্রম চালানো কঠিন হবে না। কারণ বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চালক। এ উদ্যোক্তারা যদি হৃদয় থেকে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চান তাহলে সবই সম্ভব। এ সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধ ও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। একইসঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এতে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে ১৭৬টি গ্রামের ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। শরণার্থী এসব রোহিঙ্গা খাবার সংকট, চিকিৎসাসেবাসহ আবাসন সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, স্যানিটেশনের অপ্রতুলতায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় একক ব্যক্তি, শিল্প গ্রুপ, সংগঠন কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে- সে পথ খুঁজতে এ সেমিনারের আয়োজন করে যমুনা গ্রুপ।
সেমিনারে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইস্তাম্বুলসহ পৃথিবীর অনেক দেশে গণহত্যা হয়েছে। কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হয়নি। একমাত্র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হচ্ছে মিয়ানমারে। সেখানের ধর্ষণ ও হত্যার দৃশ্য দেখে কাঁদছে পৃথিবী। নাফ নদী রক্তে লাল হচ্ছে। এ সংকটের সমাধান মিয়ানমার সরকার চায় না। এতে দেশটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ গণহত্যার বিচার করতে হবে। এর থেকে মিয়ানমার পার পেয়ে গেলে বিশ্বের কাছে উদাহরণ হিসেবে থাকবে। পৃথিবীর অনেক ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী আছে তাদেরও একইভাবে নির্মূল করার সাহস পাবে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধসহ নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়িত না করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি দেশে প্রবেশকারী চার লাখ রোহিঙ্গার খাওয়া ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। গণহত্যার বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে বিশ্ববাসীকে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক হেড অব মিশন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মানুষ খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থান ভাগ করে কিছু সময়ের (২ বছর) জন্য খাবার-দাবারের দায়িত্ব নিতে পারে দেশের কর্পোরেট গ্রুপগুলো।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ড. আশরাফুল ইসলাম সজীব বলেন, এ সংকটের একটি বড় অংশ সমাধান করতে পারে দেশের কর্পোরেট হাউসগুলো। গত ২০ বছরে দেশের কর্পোরেট হাউস অনেক দূর এগিয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করে খাবার-দাবারের দায়িত্ব নিতে পারে কর্পোরেট হাউসগুলো। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু বিশাল চ্যালেঞ্জ। এটি যেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মে রূপ না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডিন প্রশান্তভূষণ বড়ুয়া বলেন, রোহিঙ্গাদের এ সংকটে ব্যবসায়ী, কর্পোরেট গ্রুপ ও সামাজিক সংগঠনগুলো অবদান রাখতে পারলে ভালো হবে। এ মুহূর্তে রেজিস্ট্রেশন, আবাসন ও চিকিৎসা হচ্ছে তাদের বড় সমস্যা। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, যে কোনো সংকটে আমরা রক্ত, ধর্ম, জাতি ভুলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এর মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু তাহের বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের খাবারের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের একার নয়। বিশ্ববাসীর দায়িত্ব আছে। বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। বিশ্ববাসীকে খাবারের দায়িত্ব নিতে হবে।
কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি আবদুল কুদ্দুস রানা বলেন, রোহিঙ্গাদের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হয়েছে। যদিও তা মিয়ানমারে হয়নি। তিনি বলেন, এখনও অস্থায়ী ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা ৬ লাখ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় জীবনযাত্রার ওপর।
কক্সবাজার পৌরসভা মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দিতে হবে। না হলে এদের ভবিষ্যৎ কী হবে। এর আগেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা এসেছেন। তারা ফেরত নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাই তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।
কক্সবাজার সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নজিবুল ইসলাম বলেন, এ সংকটে সহায়তার জন্য দেশের শিল্প গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী গ্রুপ মানবিক সেবায় এগিয়ে আসতে পারে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিশুদের সব ধরনের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে যে কোনো রোগ শিশুদের মধ্যে মহামারী আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে এখানে রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছে। এ কাজে বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা দরকার। তা না হলে দ্রুত রেজিস্ট্রেশনের কাজ শেষ করা যাবে না।
চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যমুনা গ্রুপের এ উদ্যোগ ব্যতিক্রমী। এ উদ্যোগ সফল হোক -এটি আশা করব। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা সঠিক অবস্থানে আছে। এর সমাধান কূটনৈতিকভাবে করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক (চট্টগ্রাম) অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেক জিনিসপত্র স্থানীয়রা লুট করছেন এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়ে যে সম্মান অর্জন হয়েছে- তা ম্লান হয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়াতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এবিএম আবু নোমান বলেন, নির্যাতনের কারণে একটি দেশের (মিয়ানমার) নাগরিকরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে মর্যাদার সঙ্গে ফেরত নিতে হবে। পাশাপাশি জাতিগত ও ধর্মনিরপেক্ষ থেকে এর সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।
Leave a Reply