ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) একের পর এক ঘুষ-দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিষ্ঠানটি ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। সে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে উল্টো ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে দিয়ে এখন তদবির করাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সিরিয়ার ফ্রড অফিসও প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি অনুসন্ধান শুরু করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালের শেষদিকে বিবিসি প্যানোরামা নামক একটি অনুষ্ঠানে বিএটির সাবেক কর্মকর্তা পল হপকিন্স দুর্নীতির কিছু তথ্য ফাঁস করেন।
তিনি ১৩ বছর ধরে বিএটির কেনিয়া অফিসে কাজ করেছেন। অনুষ্ঠানে হপকিন্স বলেন, বিএটি ঘুষ ও দুর্নীতিকে ব্যবসা চালানোর ব্যয় হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে।
তার কাজ ছিল ব্যবসায়িক প্রতিযোগীরা যাতে বড় হয়ে উঠতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। এ তামাক কোম্পানিটি রাজনীতিবিদ, আমলাদের ঘুষ দিয়ে যাচ্ছে এবং হপকিন্স নিজেই তার ব্যবস্থা করে দিতেন। আর এটাই তার চাকরি ছিল।
এরপর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে। ওই সব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল তামাকবিরোধী আইনগুলোয় বাধা সৃষ্টি করা। শুধু সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনীতিবিদদের নয়, বরং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয়ও লবিংয়ের ব্যাপারে তাদের নামে অভিযোগ উঠেছে।
বুরুন্ডির একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে দেশটির টোব্যাকো বিলের খসড়া কপি সরবরাহের জন্য ঘুষ দেয়া হয়। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএটি আফ্রিকার প্রায় ৮টি দেশের সরকারকে বিভিন্ন সুবিধা দিতে চাপ দিচ্ছে। এর আগে ২০১৩ সালে সলোমন মুয়িতা নামে তাদের এক লবিস্টকে বিএটি ঘুষ দেয়ার অভিযোগে বরখাস্ত করে।
পরে মুয়িতা জানান, তিনি শুধু কোম্পানির আদেশ পালন করছেন এবং পরবর্তী সময়ে অবৈধ অপসারণের দায়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন।
দ্য ন্যাশনাল মিডিয়া অব কেনিয়া নামে কেনিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, বিএটি কেনিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির ওপর নজরদারি রাখতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী মাস্টারমাইন্ড নামের কোম্পানির ওপর নানাবিধ কর দাবি করার জন্য বিএটির কাছ থেকে কেনিয়ার রাজস্ব কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছে।
এমনকি প্রতিপক্ষের বোর্ড মিটিংয়ের তথ্য, মার্কেটিং প্লান, প্রডাকশন প্রসেস ফাঁস করার জন্য বিএটি প্রতিপক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যাপারে মাথা ঘামাত।
বাংলাদেশেও অপর্কম চালিয়ে আসছে বিএটি। ২০০৯-১০ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে রাজস্ব পরিশোধ না করে ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। ওই টাকা যাতে না দিতে হয়, সেজন্য হাইকোর্টে মামলা করেও হেরে যায় বিএটি।
এ অবস্থায় কোম্পানিটির পক্ষে সমঝোতার চেষ্টায় নামেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক।
তিনি সম্প্রতি সরকারকে চিঠি দিয়ে বিএটিবিকে (ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ) যাতে ওই টাকা দিতে না হয়, সে বিষয়ে আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর আগে অ্যালিসন ব্লেককে সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে চিঠি দেন বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেহজাদ মুনিম।
এবারই প্রথম নয়, ২০১৫ সালে ব্লেক পাকিস্তানের হাইকমিশনার থাকাকালীন টোব্যাকো কোম্পানির পক্ষ নিয়ে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে কোনো ব্রিটিশ কূটনীতিক তামাক কোম্পানির হয়ে প্রচারণা বা তদবির করতে পারেন না।
অ্যালিসন ব্লেককে লেখা চিঠিতে বিএটিবির এমডি বলেন, এনবিআর যে ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা দাবি করছে, তা কোম্পানিটির এক বছরের কর-পরবর্তী মুনাফার তিনগুণেরও বেশি।
বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সব কর্মকর্তার সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছে। আলোচনাকালে তারা সবাই স্বীকার করেছেন যে এটি একটি হয়রানিমূলক ঘটনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় বিএটিবি বিচার পেতে ব্যর্থ হয়।
এমনকি বিএটিবির মূল শেয়ারহোল্ডার ব্রিটিশ কোম্পানি রালি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশন’-এ মামলা দায়ের করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকায় কংগ্রেসম্যানদের চাপের মুখে রয়েছে। যার নেতৃত্ব দেন লয়েড ডগেট ও সিনেটর রিচার্ড ব্ল–মেনথান। তারা বলছেন, বিএটি ফরেন করাপ্ট প্রাকটিসেস অ্যাক্ট এবং এন্টি ব্রাইবারি আইনের লঙ্ঘন করছে।