রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোমবার নিউইয়র্কে এক সভার ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার সময় ট্রাম্প এ আশ্বাস দেন।
এদিন রাতে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখনও শুরু হয়নি। তবে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সূচনালগ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন চলছে, তাও ট্রাম্প জানতে চান। এ সময় শেখ হাসিনা ‘ভালো করছে’ বললে ট্রাম্প সন্তোষ প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য তুলে ধরবেন; সেখানে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকবে।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের এই মানবিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও মিয়ানমার তাদের অবস্থানে অনড়। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এবার জাতিসংঘ অধিবেশনেও থাকছেন না।
২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার পর ওইদিনই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
আর জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি সোমবার জাতিসংঘ সদর দফতরে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে যারা এসেছে, তাদের বিষয়ে বাংলাদেশকে তারা (ইউএনএইচসিআর) সাহায্য করতে চায় এবং বাংলাদেশ সফর করতে চায়।
হাসিনা-সুষমা বৈঠক : নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দফতরে এ দুই নেতার বৈঠক হয়। বৈঠকে তাদের আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট এসেছে কিনা, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়েছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা।
বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতার জেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলে জানিয়েছেন ভারতের এক কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুষমার আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু এসেছে।
বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার এক টুইটে জানান, ‘ইএএম (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।’ এরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে রবীশ কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকটি ছিল মূলত সৌজন্য। এটি সংক্ষিপ্ত একটি বৈঠক ছিল। দুই নেতার আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আসেনি।’
রবীশ কুমার বলেন, সুষমা স্বরাজ ও শেখ হাসিনার মধ্যে বৈঠকটি ছিল ‘শুদ্ধ দ্বিপক্ষীয়’ বিষয় নিয়ে আলোচনার বৈঠক। এ বৈঠক বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে প্রতিফলিত করে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে পুরোপুরি সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
ফোনে শেখ হাসিনাকে সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘মিয়ানমার যেন তাদের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়, এ জন্য ভারতের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চাপ দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের জন্য একটি ইস্যু নয় বরং এটি একটি আঞ্চলিক থেকে বৈশ্বিক বিষয় হয়ে উঠেছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, শুধু মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিজ নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে হবে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে সুষমার বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু এসেছে। সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ভারত অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে আছে, সব সময় থাকবে এবং এ সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করবে।’ রোববার আবুধাবি থেকে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের একই ফ্লাইটে নিউইয়র্কে পৌঁছান শেখ হাসিনা ও সুষমা স্বরাজ। বিমানেও তাদের মধ্যে ‘ছোটখাটো মিটিং হয়েছে’ বলেও জানান শহীদুল হক।
‘শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছি’ : কনভেইন কনফারেন্স সেন্টারে গ্লোবাল ডিল ফর ডিসেন্ট ওয়ার্ক অ্যান্ড ইনক্লুসিভ গ্রোথ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের ফলোআপ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার সরকার শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। সোশ্যাল ডায়ালগ এবং হারমোনিয়াস ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন্স প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাপক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় ‘বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে।’ নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আরএমজি খাতের শ্রম ইস্যুগুলো সমাধানে কার্যকর ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। সম্প্রীতিপূর্ণ শিল্প সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের শ্রম খাতে সামাজিক সংলাপে সহায়তার লক্ষ্যে সরকার, শ্রমিক নেতা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও মালিকদের সমন্বয়ে এ পরামর্শক পরিষদ গঠিত হয়েছে।’
বৈঠকে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফেন, আইএলও মহাপরিচালক গাই রেডার ও অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) মহাসচিব অ্যাঞ্জেল গুররিও বৈঠকে বক্তব্য দেন।
বৈঠকে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইনে পরিবর্তন এনে তা ‘শ্রমিকবান্ধব আইনে পরিণত করেছে, যা কর্মপরিবেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে।’
তিনি বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি গত পাঁচ বছরে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শ্রমিকদের উন্নত জীবন-জীবিকা এবং কর্মপরিবেশ ও তাদের উপার্জনের স্থিতি নিশ্চিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও নিয়োগদাতা এবং সরকারের প্রতিনিধি একত্রে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেখানে সরকার সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী পদক্ষেপের সুবাদে নাগরিকদের মাথাপিছু আয় গত নয় বছরে অন্তত তিন গুণ বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যৌন নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের অবস্থান জিরো টলারেন্স : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের মাঝে যৌন অপরাধ নির্মূলে সংস্থাটির মহাসচিবের যথাযথ পদক্ষেপের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি ভিকটিম সাপোর্ট ফান্ডে ১ লাখ ডলার প্রতীকী চাঁদা দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বোচ্চসংখ্যক সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্য নিয়োগকারী হিসেবে আমরা যৌন নির্যাতন ও অপরাধ বন্ধের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করি। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হচ্ছে জিরো টলারেন্স।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার জাতিসংঘ সদর দফতরে ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল চেম্বারে যৌন নির্যাতন ও অপরাধ দমন শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযোগের সঙ্গে জড়িতদের তাদের নিজ খরচে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের ভাতা বন্ধ থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটি আমাদের দৃঢ় নৈতিক মূল্যবোধ, উৎসাহব্যঞ্জক অনুপ্রেরণা ও উচ্চমানের শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা মনে করি, যৌন নির্যাতনের শিকার সবাই ন্যায়বিচার লাভ ও পুনর্বাসনের দাবিদার।’
হাসিনা-মাহমুদ আব্বাস বৈঠক : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সোমবার বৈঠকে মিলিত হন। গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের নিজ কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফিলিস্তিনি নেতার বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনের সংকটের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রেস সচিব বলেন, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘এটি একটি দুর্যোগ। সর্বত্রই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মানবিক ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে।’
দুই নেতার সাক্ষাতের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন।