একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে বর্তমান, সাবেক এবং সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে জোর তদবির অব্যাহত রেখেছেন।
বলতে গেলে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের কাড়াকাড়ি চলছে। পছন্দের এলাকা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ইতিমধ্যে শতাধিক চিঠি গেছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি কমিশনে হাজির হয়ে তদবির করছেন।
কোনো কোনো আসনে এমপিদের পক্ষে স্থানীয় নাগরিকরা ইসির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখতে পাল্টা তদবির করছেন কোনো কোনো সংসদ সদস্য।
আবার কেউ কেউ ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় সীমানায় ফিরতে চেয়েছেন। আগামী নির্বাচনে ভোটের বৈতরণী পার হতে সাবেক, বর্তমান ও সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের এমন দেৌড়ঝঁাপ চলছে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রায় সব জেলা থেকে নির্বাচন কমিশনে আবেদন জমা পড়ছে।
সীমানা সংক্রান্ত যেসব চিঠি বা আবেদন কমিশনে জমা হচ্ছে তা এ সংক্রান্ত কমিটি প্রধান মো. রফিকুল ইসলামের (নির্বাচন কমিশনার) কাছে পাঠানো হচ্ছে।
পাশাপাশি সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনীর কাজও চলছে। আইন সংশোধন হওয়ার পর সীমানা নির্ধারণের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হবে।
আইন সংশোধন কাজের সুবিধার্থে ইতিমধ্যে কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যদিও রোডম্যাপে অক্টোবরে তিনশ’ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া তালিকা প্রণয়ন, নভেম্বরে তা প্রকাশের পর ডিসেম্বরে চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের কথা উলে্লখ রয়েছে।
সংশি্লষ্টদের শঙ্কা, যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে রোডম্যাপে ঘোষিত সময়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত আবেদন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ সংক্রান্ত অনেক আবেদন আসছে। এসব আবেদন আমার দফতরে রাখা হচ্ছে।
আবেদনগুলোর মধ্যে যেগুলো আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য তা আমলে নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, Èসীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। আইন সংশোধনের কাজ চলছে।
তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, Èবিদ্যমান ও প্রস্তাবিত দুই আইনেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন থেকেই আপত্তি ও মতামত জানানোর আহ্বান জানানো হয়। ওই সময় যেসব আবেদন পাওয়া যায় সেগুলো আমলে নেয়া হয় এবং গণশুনানি করে সীমানা পুনর্নির্ধারণের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। সুতরাং খসড়া তালিকা প্রকাশের আগে যেসব আবেদন জমা পড়ছে সেগুলো বিবেচনায় নেয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই।’
ইসি সূত্রে জানা যায়, বিদু্যত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম এমপি সম্প্রতি ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবকে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে কুমিল্লা-৯ আসন আগের মতো নির্ধারণ করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। চিঠিতে তিনি বলেছেন, Èআমার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লা-৯ লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত।
লাকসাম উপজেলার বাকই (উত্তর) ইউনিয়নটি নবগঠিত লালমাই উপজেলার অন্তভর্ুক্ত হওয়ায় ওই ইউনিয়নকে কুমিল্লা-১০ আসনে যুক্ত করে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাকি ইউনিয়নগুলো নিয়ে কুমিল্লা-৯ আসন নির্ধারণের অনুরোধ করছি।’ প্রসঙ্গত বর্তমানে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-৯ এবং সদর দক্ষিণ ও নাঙ্গলকোট উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-১০ গঠিত।
ফেনী-২ ও ৩ আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বরাবর চিঠি দিয়েছেন ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাজী রহিম উল্যাহ। দুই পৃষ্ঠার এ চিঠিতে তিনি এ দুই আসনের ভেৌগোলিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য দিক তুলে ধরে বলেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত সোনাগাজী ও সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ফেনী-৩ আসন গঠিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কিছু দিন আগে ফেনী-৩ আসনকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়।’
চিঠিতে ২০০৮ সালের আগের অবস্থা অর্থাত্ সোনাগাজী ও সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে ফেনী-৩ নির্বাচনী এলাকা গঠনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত বর্তমানে সদর উপজেলা নিয়ে ফেনী-২ এবং সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলা নিয়ে ফেনী-৩ আসন গঠিত হয়েছে।
২০০৮ সালের আগের অবস্থায় বরিশাল-৪ আসন ফিরিয়ে দিতে সিইসির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বরিশালের হিজলা উপজেলা বড়জালিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও হিজলা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাওয়ানুর চেৌধুরী।
তিনি বর্তমান বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসন পরিবর্তন করে আগের মতো হিজলা ও মুলাদী উপজেলা নিয়ে বরিশাল-৩ আসন পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। একই ধরনের আবেদন করেছে হিজলা উপজেলার সাবেক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি।
একইভাবে ইসিতে চিঠি দিয়েছেন কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিকুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ মিয়া। তারা নির্বাচনী এলাকার পূর্ব ইতিহাস, ভেৌগোলিক অখণ্ডতা, প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করে হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-১ এবং দাউদকান্দি ও তিতাস উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-২ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন।
আরও জানা গেছে, বিএনপি থেকে এমপি মনোনয়নপ্রত্যাশী দাবি করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাস্টার মো. আবদুল ওয়াহেদ।
তিনি ৩ লাখ ৯০ হাজার জনসংখ্যা এবং ২ লাখ ২২ হাজার ভোটারসংবলিত শ্যামনগর উপজেলাকে একক নির্বাচনী এলাকা হিসেবে সাতক্ষীরা-৫ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আর্জি জানিয়েছেন। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মো. মামুনুর রশীদ ও শেখ মোহা. ফরিজ উল্যাহ শিপন যেৌথ চিঠিতে রায়পুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন এবং লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১, ২, ৩, ও ৪ নম্বর ইউনিয়ন নিয়ে লক্ষ্মীপুর-২ সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন।
ইসি সূত্রে জানা যায়, ইসির ঘোষিত রোডম্যাপে অক্টোবরের মধ্যে খসড়া তালিকা প্রণয়নের পর নভেম্বরে তা প্রকাশ করা হবে। ওই সময় খসড়া তালিকার ওপর দাবি, আপত্তি ও সুপারিশ আহ্বান করবে কমিশন। কমিশনে জমা পড়া আপত্তির বিষয়ে অঞ্চলভিত্তিক শুনানি শেষে ডিসেম্বরে চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।
ওই লক্ষ্য অনুযায়ী, সীমানা সংক্রান্ত আইনের খসড়ার ওপর মতামত দিতে কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার কনসালট্যান্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম এবং আইন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। কনসালট্যান্টের মতামত পাওয়ার পর কমিশন সভায় তা চূড়ান্ত করে আইন পাসের জন্য সরকারের কাছে পাঠানো হবে।