• বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন

মৃত্যুর পর যেভাবে বেঁচে আছেন চে

আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

চে নামটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিপ্লবীর মুখ। যিনি ভীষণ রকমের রোমাঞ্চপ্রিয় আর স্বপ্নবাজ। যিনি তারুণ্যের প্রতীক হয়ে বৈষম্যহীন ও সবার জন্য সমান একটা পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন ছুড়ে দেন। মৃত্যুর অর্ধ শতক পরও তিনি তাই বেঁচে আছেন লাখো মানুষের হৃদয়ে। সন্তান, স্বজন, ভক্ত-অনুরাগীদের মাঝে এখনো যেভাবে বেঁচে আছেন, সেভাবে কী বাঁচতে চেয়েছিলেন চে?

১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন আর্নেস্তো গুয়েভারা। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি চে নামে পরিচিত। ২০ বছর বয়সে বুয়েনস এইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু। এর দুই বছর পর ১৯৫০ সালে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে প্রিয় মোটরসাইকেল ‘লা পোদেরোসা’য় করে যাত্রা করেন তিনি। এই যাত্রা তাঁর জীবনদর্শনকে বদলে দিয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও এ ব্যাপারে করণীয় কী, সেটা একটা আকার পায়। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে কী করতে হবে।

চের ঐতিহাসিক মোটরসাইকেল যাত্রা ছিল দুই দফায়। প্রথমবার পাড়ি দেন সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার। আর দ্বিতীয় দফায় আট হাজার কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, দারিদ্র আর বঞ্চনা থেকে অসহায় মানুষগুলোকে মুক্তি দিতে হলে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তি নেই। মোটরসাইকেলে করে তাঁর এই যাত্রা নিয়ে নির্মিত হয়েছে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ছেন বলে কবিতাকে দূরে ঠেলে দেননি। কবিতা পছন্দ করতেন, নিজেও লিখতেন। অনেকে বলেন, কবিতা তাঁর মধ্যে রোমান্টিকতা, ভালোবাসা আর স্বপ্নের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি চিকিৎসক হয়ে আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে সবার জন্য সমান একটা পৃথিবী গড়ার লক্ষ্য পূরণে মাঠে নামেন। বিনা পয়সায় সেবা দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যান। সঙ্গী করেন, কিউবা থেকে কঙ্গো পর্যন্ত সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন।

কিউবার সান্তা ক্লারায় চে গুয়েভারার ভাস্কর্য। ছবি: রয়টার্সপরের বছর চে জড়িয়ে পড়েন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে। সেখান থেকে মেক্সিকো সিটিতে। আর এই মেক্সিকো সিটিতেই কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ও তাঁর ভাই রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। এই ত্রিরত্ন ও তাদের অনুসারী গেরিলাদের হাত ধরে কিউবায় বিপ্লব সফল হয় ১৯৫৯ সালের প্রথম দিনটিতে। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান। বিপ্লব-পরবর্তী কিউবার পুনর্গঠনে কাজ করতে থাকেন চে। আফ্রিকার কঙ্গো হয়ে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় যান। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর সেখানকার দুর্গম অরণ্যে সরকারি সেনাদের হাতে বন্দী হন। পরের দিন বন্দী অবস্থায় এক স্কুলঘরে গুলি চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।

চের মৃত্যুর ৫০তম বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানায় কিউবার হাজার হাজার মানুষ। চে গুয়েভারার সমাধিতে একটি সাদা গোলাপ রেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান পুরোনো বন্ধু কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো। মৃত্যুর ৫০ বছর পর কিউবায় চে কেমন আছে, তা নিয়ে ‘ইন দ্য শ্যাডো অব চে’ নামে একটি অনুষ্ঠান বানিয়েছে বিবিসি। সেখানে দেখা গেল, জায়গায় জায়গায় চের প্রতিকৃতি। বিলবোর্ডে আর হাতে হাতে থাকা ব্যাংক নোটে শোভা পাচ্ছে তাঁর ছবি। তরুণ-যুবকের গায়ের টি-শার্ট, ভবনের সীমানা প্রাচীরের দেয়ালচিত্র, প্রিয়জনকে দেওয়ার জন্য স্মারক, নারীদের কানের দুল—কোথায় নেই চে!

কিউবার প্রাচীরে প্রাচীরে চের দেয়ালচিত্র। ছবি: এএফপিবলিভিয়ার লা হিগুয়েরা নামের সীমান্তবর্তী যে গ্রামে চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেও একই অবস্থা। জায়গাটা এখন ব্যস্ততম পর্যটনকেন্দ্র। চারপাশে শুধু চে আর চে। চের মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পর সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই হুয়ান মার্তিন গুয়েভারা। ‘চে, মাই ব্রাদার’ নামে নিজের লেখা বইয়ে সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এখানকার সবার কাছে চে একজন সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন। তাঁর ছবি সামনে নিয়ে প্রার্থনা করা হয়, অলৌকিক প্রত্যাশা করা হয় তাঁর কাছে। এ এক ভয়ংকর অবস্থা। আমার ভাইয়ের চিন্তা ও আদর্শ ধুয়েমুছে গেছে।’ তাঁর মতে, চের ভাস্কর্য গড়ে তাঁকে আরাধনা করার প্রয়োজন নেই। চেকে এই বেদি থেকে নামিয়ে আনতে হবে। সবার উচিত তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে দেখা। স্রেফ মানুষ, যিনি মার্ক্সবাদী আদর্শে বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়তে চেয়েছিলেন। আর আজকের বিশ্বে চে গুয়েভারার চেয়ে বেশি দরকার এমন একজন মানুষ যার পরিবর্তনের ভাবনা আছে, আছে সুস্পষ্ট নীতি যা অর্থবিত্ত বা ক্ষমতার কাছে কখনো বিক্রি হয় না।

চে কীভাবে তাদের জীবনে আছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে কিউবার লোকজন বলছিলেন, ‘আমরা তাঁকে হৃদয় থেকে অনুভব করি’, ‘তিনি আমাদের হৃদয়ে আছেন’, ‘চে আমাদের কাছে সম্মানের আসনে আছেন’—এমন অনেক কথা। আবার কেউ কেউ বললেন, চে বেঁচে থাকলে তাদের জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। হয়তো এখনকার চেয়ে ভালো থাকতেন। তাদের কথায় এটা স্পষ্ট, বিপ্লবী চে তাদের মন থেকে মুছে যাননি। সম্মানের আসনে বসে আছেন। তাঁকে ত্রাতার ভূমিকায় কামনা করেন।

টি-শার্টেও ঠাঁই করে নিয়েছেন বিপ্লবী চে। ছবি: এএফপিএ তো গেল স্বজন আর অনুসারীদের কথা। বিখ্যাত বাবার সন্তান হিসেবে কেমন আছেন চের ছেলে আর্নেস্তো গুয়েভারা? আর্নেস্তোর বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন বাবাকে হত্যা করা হয়। তারপর নিজের মতো বেড়ে উঠেছেন চে গুয়েভারা ও এলিদা মার্চের এই সন্তান। বললেন, বাবার স্মৃতি তাঁর মনে নেই। তবে বাবার কাছ থেকে তিনি একটা জিনিস পেয়েছেন, সেটা হলো মোটরসাইকেলের প্রতি ভালোবাসা। ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতি, গতি, মোটরসাইকেল ও গাড়ি তাঁর ভীষণ পছন্দের বলে জানালেন।

মোটরসাইকেল ভ্রমণ চেকে বিপ্লবের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আর ছেলেকে নিয়েছে পর্যটন ব্যবসার দিকে। নোর্টন ৫০০ সিসি মডেলের যে ‘লা পোদেরোসা’ মোটরসাইকেলে করে চে ঘুরেছিলেন, ছেলে সেই নাম আর বাহন নিয়ে চালু করেছেন লা পোদেরোসা ট্যুরস। বিদেশি মূলধন ও কিউবার রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। মোটরসাইকেলে করে পর্যটকদের কিউবা দেখান। তাঁর গ্রাহক তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও আর্জেন্টিনা থেকে আসা পর্যটকেরা।

মোটরসাইকেল ভীষণ প্রিয় ছিল চে গুয়েভারার। এই প্রজন্ম মোটরসাইকেলে চের ছবি লাগিয়ে ঘুরতে পছন্দ করে। ছবি: এএফপিআমৃত্যু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বাবার সন্তান হিসেবে তিনি কি পর্যটনে পুঁজিবাদী ক্যারিয়ার গড়েছেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে আর্নেস্তো বলেন, ‘এটা সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ, তাতে কিছু যায় আসে না। এটাতে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আমার কাছে, আমরা একটা ভালো কাজ করছি যার মাধ্যমে দেশ লাভবান হচ্ছে।’ জানালেন, বাবাকে ভালোবাসেন অনেক। মাকেও। তাই নিজেকে আর্নেস্তো গুয়েভারা মার্চ নামে পরিচয় দেন। বাবার ছায়ায় নয়, নিজের পরিচয়ে নিজের মতো বেঁচে থাকতে চান তিনি। বাবা বাবার সম্মানের জায়গায় থাকুক আর তিনি নিজে যা তারজন্যই অন্যরা তাঁকে সম্মান করুক—মনেপ্রাণে এটাই চান আর্নেস্তো।

(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বিবিসি, গার্ডিয়ান, এএফপি ও আল-জাজিরা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ