এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন:- কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুই বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়াসহ পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অবৈধ ভাবে আসছে শত শত মায়ানমারের গরু – মহিষ। যাচ্ছে চাল, ডাল, তেল,ঔষধ ও বিভিন্ন নিত্য পণ্য সামগ্রী। সীমান্ত লাগোয়া এই জনপদ এখন ইয়াবা, আইস ,অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেয়া তথ্যানুযায়ী দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, অস্ত্র কারিগর, অস্ত্র প্রশিক্ষকসহ অপরাধী চক্রের বিচরণ ক্ষেত্র এসব পাহাড়ি জনপদ।
শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও আরকান আর্মির সাথে সখ্যতা গড়ে পুরো সীমান্ত এলাকাকে অশান্ত করার পায়তারা চালাচ্ছে তারা ।এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে রামু কচ্ছপিয়ার সন্ত্রাসী জামসেদ ও গর্জনিয়ার ডাকাত সর্দার শাহীন। খুন,অস্ত্র চোরাচালান ও গরু পাচারসহ ৪ টি মামলার পলাতক আসামী জামসেদ এবং অপরদিকে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় রয়েছে ১৭ টি মামলা।
সর্বশেষ ডাকাত শাহীন ও জামসেদ ভাড়ায় আনা নরসিংদীর সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত ভিকচাঁন মিয়া (৩৪) কে সোনাইছড়ি জারুলিয়াছড়ি থেকে গত ২৫ (মঙ্গলবার) ফেব্রুয়ারী রাত অনুমান সাড়ে ১২ টায় গোপন সংবাদের ভিক্তিতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নাইক্ষ্যছড়ি থানা পুলিশ অস্ত্র ও রাইফেলের গুলিসহ গ্রেফতার করে।
জানাগেছে, সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভাড়ায় আনা হয়েছিল ভিকচাঁনকে। এই মামলায় ডাকাত শাহীনসহ অন্তত ৬ জন এবং অজ্ঞাত আরো তিনকে আসামী করা হয়েছে। অন্যদিকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারী (বুধবার) ভোর ৬ টায় নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়াড়ের বামহাতিরছড়া ব্রীজের উপর থেকে ১১ টি মায়নমার থেকে সীমান্ত পার করে চোরাই পথে আসা ১১ টি বলদগরু জব্দ করে পুলিশ।এ সময় গরুর সাথে থাকা প্রাপ্ত বয়স্ক ওবাইদুল হক ও জসিম উদ্দিন নামে দুই পাচার কারীসহ ৯ শিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের দেয়া স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে পাচার করে আনা গরুর মালিক জামসেদের নাম।ফলে এই মামলায় তাকেও আসামী করা হয়েছে। একাধিক জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের অভিমত পাহাড়ি সীমান্তবর্তী দূর্গম জনপদের ত্রাস হচ্ছে ডাকাত শাহীন ও জামসেদ। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে সব ধরনের অপরাধ ও অবৈধ বানিজ্য।
সীমান্ত দিয়ে গরু মহিষ পার করতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াসহ দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন গরু পাচার করতে শ্রমিক হিসাবে যারা কাজ করছে সবাই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত বলে জানা গেছে। আর গরু পাচার করতে তারা ভারী অস্ত্র তুলে দিচ্ছে শিশু – কিশোরদের হাতে। রামুর কচ্ছপিয়া ও গর্জনিয়া এলাকা ও সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় মিয়ানমার থেকে আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে শতশত গরু-মহিষ। দুই উপজেলায় এই পাচারচক্রের সাথে জড়িত অনেকেই গত এক বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন । এ চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা চালাতে পিছপা হয়না।
এমনই এক ঘটনায় গত বছরের এপ্রিল মাসে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি। গত বছর ৫ আগস্টে সরকার পতন হলে জোয়ারিয়ানালা ও রশিদ নগর এলাকা হয়ে সড়ক পথে বিভিন্ন উপায়ে অবৈধ গরু মহিষ পাচারে পাচারকারী পরিবর্তনও হয়। তবে সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে সবাই এক সাথে কাজ করছে।আগে আওয়ামী লীগের লোকজন নেতৃত্ব দিতেন আর এখন জামায়াত বিএনপির লোকেরা দিচ্ছেন। জানা গেছে, সীমান্ত পয়েন্ট হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা গরু মহিষ ও ইয়াবা রামুর কচ্ছপিয়া, উখিয়ার ঘোনা গর্জনিয়া ইউনিয়নের বড়বিল, ক্যাজরবিল, জোয়ারিয়ানারা ইউনিয়ন, রশিদনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় মজুত করে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হয়।
সীমান্ত এলাকা ঘুরে গবাদি পশু পাচারে সংযুক্ত বেশ কয়েকজনের সাথে সরাসরি কথা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি এবং রামুর হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও চোরাই পথে মিয়ানমারের গরু আসছে।
সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, চিহ্নিত ১৫ ব্যক্তির নেতৃত্বে দুই শতাধিক চোরাকারবারি,ইয়াবা ব্যবসায়ী, হুন্ডি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ডাকাতি ইত্যাদি অপকর্মের দুই নায়ক শাহীন ডাকাত ও জামসেদ অন্যতম। ট্রাকযোগে এসব গরু পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানকার কিছু লোকের সহায়তায় বেশিরভাগ টাঙ্গাইল ভোয়াপুরের শাহিন, বি. বাড়িয়ার সেন্টু মিয়া এই দুই জনের গরু পাচারে সহায়তা করছে কচ্ছপিয়ার শাকিল মেম্বার ও জোয়ারিয়ানালার শাকিল নামের একজন।
আরো যারা গরু পাচারের গড়ফাদার হিসাবে নাম শোনা গেছে, তারা হলেন, চাকমারকুলের আবু তাহের, উখিয়ার কিং জয়নাল, ঈদগাও এলাকার আমান খুশবো , চকরিয়ার রমজান, বাবুল ও আব্দু রহিম, টাঙ্গাইল ভোয়াপুর এলাকার মোহাম্মদ আলম, হারুন, খোকন, টেকনাফের আমিন, ঘুমধুমের মিজান মাস্টার ও কুমিল্লার মিজানের নাম উঠে এসেছে। তারা সরাসরি মায়ানমার সিমান্তে গিয়ে মায়ানমার নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে গরু ও ইয়াবা ক্রয় করে স্থানীয় জোয়ারিয়ানালা, কচ্ছপিয়া, রশিদ নগর, গর্জনিয়া, কাউয়ারখোপ এলাকার অস্ত্রধারি কিছু সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সিমান্ত পার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
এসব গরু পাচারকারীদের সঙ্গে সহায়তাকারী হিসাবে কাজ করছে জোয়ারিয়ানালার ডালিম, শুক্কুর, শফিকুর রহমান, নুরুল আবছার, রামু চেরাংঘাটা মোশাররফ ও ইউনুস, কাউয়ারখোপের বাবু, খোকন, , সুজন, রাকিব, হাসান, বহু মামলার আসামি মোশাররফ, আব্দুল্লাহ, আজিম, সোহেল, যুবদল নেতা জহির, বহু মামলার আসামি রুবেল, হাসান, শানু, ইকবাল, সমন্নয়ক পরিচয়দানকারী শাকিল রশিদ নগর এলাকার ডাকাত সাদ্দাম, ডাকাত মোস্তাক, তৈয়ব উল্লাহ, কৃষকদল নেতা আবছার, শাহাবুদ্দিন, ইসলাম, খরুলিয়া মিজানসহ আরো বেশ কয়েকজন।অনেকে ইয়াবার টাকা বা আয় বহির্ভূত অর্থ বৈধ করতে গবাদি পশুর বা হাট বাজারের ব্যবসায় পূঁজি বিনিয়োগ করেছেন।
এদিকে দেশীয় খামারের গরু দাবি করে মিয়ানমার থেকে আনা অবৈধ গরু মহিষ ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়ন ও গর্জনিয়া বাজারসহ বিভিন্ন হাট বাজারের ক্রয় বিক্রয় রশিদ দেখিয়ে গবাদিপশু পাচার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিটি গরু ও মহিষ মিয়ানমার থেকে ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনে তা বিক্রি করা হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। মাঝে মধ্যে মালিকবিহীন গরু আটক হলেও চোরাকারবারিরা রয়ে যায় অধরা। এ অবস্থায় সীমান্তে গরু মহিষ ও মাদকপাচার নিয়ে সচেতন মহলের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই মিয়ানমারের গরু মহিষের দামও তুলনামূলক এখানকার তুলনায় অনেক কম। আর অল্পপুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও কিছু মিডিয়াকর্মী স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এ গরু পাচারের সঙ্গে লিপ্ত হয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আগে আলীকদম ও লামা পথে বার্মিজ গরু মিয়ানমার থেকে পাচার হলেও বর্তমানে চোরাই গরু পাচারকারীরা তাদের পথ পাল্টে বেছে নিয়েছে নতুন পথ। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের বিভিন্ন পথে অবাধে গরু পাচার করে আসছে। তাদের দাবি, এ গরু পাচারের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা সবাই এক হয়ে গেছে। আবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। এসব গরু পাচারের সময় পাচারকারীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকার কারণে তাদের কাছে কেউ যেতে সাহস করছে না।
এদিকে সিমান্ত এলাকা গর্জনিয়া বাজার ইজারাদার মো. রহিম উদ্দিন অবৈধ পাচারকৃত গরু, মহিষ ও বিভিন্ন পণ্য পাচারে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামুর বরাবর আবেদন দাখিল করে। এর ওপর ভিত্তি করে গত ৩০ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামু উপজেলার বিভিন্ন দফতরকে তা অবগত করে চিঠি প্রদান করে ও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।অনেকের মাঝে ইজারাদারের উদ্দেশ্য নিয়ে ও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ গবাদি পশুসহ পণ্য পাচার রোধ করা তার উদ্দেশ্য নয়।সমস্যা হচ্ছে মায়নমার থেকে আসা গরু মহিষ ও এখান থেকে যে সব নিত্যপণ্য যাচ্ছে তা বাজারে বেচা বিক্রি হচ্ছেনা।ফলে তিনি ইজারার টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না।
ইজারাদার রহিম উদ্দিন জানান, অবৈধ পণ্যের কারণে বাজার ইজারার টাকা তুলতে হিমশিম খাচ্ছি। সব পণ্য চোরাই পথে চলে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বাজারে নিজস্ব পণ্য তোলার সুযোগ পাচ্ছে না বিধায় টোল আদায় কম হচ্ছে। আশা করছি প্রশাসন এই অবৈধ গরু পাচার বন্ধ করবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, অবৈধ গরুসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্য সামগ্রী পাচার রোধে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। অবৈধ গরু পাচার বন্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি মাধ্যমে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি সংশ্লিষ্ট দফতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সম্প্রতি রামুর রশিদ নগর এলাকায় কিছু বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা বন্ধ করা হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি মো. মাশরুরল হক বলেন, চোরাচালান, মিয়ানমারের গবাদি পশু অবাধে অনুপ্রবেশ, ইয়াবা পাচার, রোহিঙ্গাদের অপতৎপরতা, অস্ত্রের ব্যবহার, অপরাধীদের বেপরোয়া বিচরণ, চুরি -ডাকাতি ও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে পুলিশ রাতদিন পরিশ্রম করছে। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী সহসায় সবকিছু সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে।গুটি কয়েক সন্ত্রাসী ডাকাতের কারণে এই জনপদে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দুষ্কৃতকারীদের প্রতিরোধে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছেন ,সরকার ইচ্ছে করলে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।আর এই অঞ্চলে অবৈধ গবাদি পশুর হাটসহ যাবতীয় সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় আছে।কারণ দেশের গো মাংসের চাহিদা মেটাতে শাহপরীর দ্বীপ করিডোর চালু করা হয়েছিল ২০০২ সালে।দেশীয় খামারীদের চাপের মূখে ২০২১ সালে ওই করিডোর বন্ধ করে দেন সরকার। তখন প্রতি গরু থেকে সরকার ৫০০ টাকা করে রাজস্ব পেতো। তা বন্ধ হওয়াতে গরু মহিষ অবাধে আসছে। আর নাইক্ষ্যংছড়ি, গর্জনিয়া- কচ্ছপিয়াতে গড়ে উঠেছে ৩ হাজারের অধিক অবৈধ গবাদি পশুর খামার।বৃদ্ধি পেয়েছে চোরাচালান, ইয়াবা ও অস্ত্র বানিজ্য।অথচ টেকনাফ এতবড় স্থলবন্দর দিয়ে তেমন একটা মালামাল উঠানামা হচ্ছে না।এই অপরিণত সিদ্ধান্তের ফলে প্রচুর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।