আজ ১০ জানুয়ারি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। অবসান ঘটে বাঙালির হাজার বত্সরের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার। বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। কিন্তু আমরা স্বাধীন হইলেও বিশাল একটি অপূর্ণতা থাকিয়া গিয়াছিল। এই অভূতপূর্ব ইতিহাসের যিনি রচয়িতা, যাঁহার নামে মহান মুক্তিযুদ্ধে হাসিমুখে প্রাণ উত্সর্গ করিয়াছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, মাথা পাতিয়া লইয়াছে অকল্পনীয় দুঃখ ও ক্লেশ—তাঁহাকে ছাড়া এই বিজয় কি পূর্ণতা পাইতে পারে? পারে না। তাই অনিবার্যভাবেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি হূদস্পন্দনে তখন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইতেছিল সেই শূন্যতার সর্বব্যাপী হাহাকার। অবশেষে তিনি আসিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার হইতে মুক্ত হইয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন-দিল্লি হইয়া তাহার আজন্মলালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন পরম মমতায়। সেই দিন স্বজনহারানো সর্বস্বান্ত মানুষ হূদয় উজাড় করিয়া বরণ করিয়া নিয়াছিল তাহাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে। নেতা ও জনতার আনন্দাশ্রু মিলিয়া-মিশিয়া সেইদিন একাকার হইয়া গিয়াছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ ছিল ভয়ঙ্করভাবে কন্টকাকীর্ণ। মুুক্তিযুদ্ধকালে দীর্ঘ ৯টি মাস বঙ্গবন্ধুৃকে শুধু যে দুই হাজার মাইল দূরবর্তী পাকিস্তানের নির্জন একটি কারাগারের ‘ডেথ সেলে’ বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছিল তাহাই নহে, সর্বাত্মক প্রস্তুতিও চলিতেছিল তাঁহাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর। বিচারের নামে প্রহসন চলিতেছিল সামরিক জান্তার গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। বিশ্বের বহু খ্যাতনামা রাষ্ট্রনায়কসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁহার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরিয়া আসিয়া রেসকোর্স ময়দানে এক আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, তিনি ফাঁসির জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন। বঙ্গবন্ধু ইহাও বলেন যে, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হইয়া যাইবে যদি তাহার বাংলার মানুষ পেট ভরিয়া খাইতে না পায়, মা-বোনেরা কাপড় না পায়। তিনি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে এশিয়ার ‘রাইজিং টাইগার’ হিসাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখিয়া মুগ্ধ না হইয়া পারিতেন না।
স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু নূতনভাবে গড়িয়া তোলেন। রক্তক্ষয়ী বিজয়ের পর মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে অনন্য নজির স্থাপন করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখাইয়া গিয়াছেন জাতিকে, তাহা সফলতা পাইতে শুরু করিয়াছে তাঁহারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হইতে চলিয়াছি। বাংলাদেশ হইয়াছে উন্নয়নের রোল মডেল। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের মৃত্যুকূপ হইতে বঙ্গবন্ধু সেইদিন দেশে ফিরিয়াছিলেন বলিয়াই সাফল্যের এই ভিত রচনা করা সম্ভব হইয়াছে।