• সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

তুরস্কে কুর্দিদের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ও এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রভাব

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : রবিবার, ২ মার্চ, ২০২৫

তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) দেশটির সরকারের সঙ্গে চলমান ৪০ বছরের সংঘাতের অবসান ঘটানোর জন্য যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারণ গত চার দশক ধরে তুরস্কের সরকার এবং পিকেকের মধ্যে চলা এই সংঘাতে হাজার হাজার প্রাণহানি হয়েছে। পিকেকের পক্ষ থেকে শনিবার (১ মার্চ) এক বিবৃতিতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়— তারা ভবিষ্যতে কোনো সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করবে না, যদি না তাদের বিরুদ্ধে কোনো হামলা হয়।

এটি তুরস্কের রাজনৈতিক এবং সামরিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যেখানে প্রথমবারের মতো পিকেকে তাদের লড়াইয়ের পথে বিশাল একটি পরিবর্তন আনছে। এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা তুরস্কের প্রধান কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছে।

এর আগে, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ডিইএম পার্টির প্রতিনিধিরা ওজালানকে দেখতে কারাগারে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি পিকেকে নেতাদের অস্ত্র সমর্পণের এবং বিদ্রোহী দলটিকে চিরতরে বিলুপ্ত করার আহ্বান জানান। ওজালান দাবি করেন, তুরস্কের কুর্দি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।

তুরস্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও এরদোয়ানের প্রভাব

এটি এমন একটি সময়ে ঘটেছে, যখন তুরস্কের রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত সংকটপূর্ণ মুহূর্ত চলছে। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, যিনি তুরস্কের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন, আগামী নির্বাচনে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ হারাতে পারেন। তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, তিনি আরেকটি নির্বাচন লড়তে পারবেন না, তবে ডিইএম পার্টির সমর্থন তার রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিইএম পার্টির সমর্থন তুরস্কের নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং আগাম নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এরদোয়ান যদি এই সমর্থন পায়, তবে তার ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবেন।

এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে ডিইএম পার্টি কুর্দি জনগণের মানবাধিকার এবং আবদুল্লাহ ওজালানের মুক্তি দাবী করে আসছে। তাদের দাবি, কারাবন্দি কুর্দি নেতা ওজালানকে মুক্তি দিতে হবে এবং কুর্দি জনগণের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই রাজনৈতিক অবস্থা পিকেকের যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে আরো জোরালো করে তোলে এবং এটি তুরস্কের রাজনীতিতে নতুন একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার সূচনা হতে পারে।

কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিকেকের ইতিহাস
পিকেকে ১৯৭৮ সালে আবদুল্লাহ ওজালান প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে তাদের দাবি ছিল, তুরস্কের কুর্দি জনগণের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল কুর্দিদের জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতা অর্জন। তবে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো পিকেকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। পিকেকের দীর্ঘদিনের সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে তুরস্কে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

ওজালান ১৯৭৯ সালে তুরস্ক থেকে পালিয়ে সিরিয়াতে চলে যান, কিন্তু ১৯৯৮ সালে সিরিয়া তাকে নির্বাসিত করতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে তাকে কেনিয়া থেকে আটক করে তুর্কি সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন থেকেই তিনি তুরস্কের কারাগারে রয়েছেন।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতি
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর, পিকেকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা তুরস্ক সরকারের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন পথ অনুসরণ করবে। পিকেকে জানিয়েছে, তারা নতুন করে কোনো ধরনের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণ করবে না, যতক্ষণ না তাদের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন বা আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা তুরস্কের সরকার এবং পিকেকের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তুরস্কের সরকারও এই শান্তি আলোচনা এবং যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপে আন্তরিক হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি দেশের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হয়। তবে সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

ভবিষ্যত কি হতে পারে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিকেকে তাদের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তুরস্কে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার নতুন একটি দ্বার উন্মোচন করেছে। তবে তুরস্কের সরকার যদি এই শান্তি প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করে এবং কুর্দি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সৎ মনোভাব দেখায়, তবেই সত্যিকারের শান্তি আসতে পারে। কুর্দি গোষ্ঠীর জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হতে পারে, কারণ তুরস্কে কুর্দি জনগণের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিনের সংগ্রাম চলছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ