সম্প্রতি দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের চার বত্সর পূর্তি হইল। সাফল্য-ব্যর্থতার তুলাদণ্ডে দেশে-বিদেশে সরকারের জন্য প্রশংসার ফুলঝুরিই মিলিতেছে অধিক পরিমাণে। কিন্তু সাফল্যের এই পাদপ্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো ঘাপটি মারিয়া সরকারের প্রশংসার বৃহদংশ নষ্ট করিয়া দিতেছে সরকারের কিছু কিছু অঙ্গসংগঠন। বত্সরজুড়িয়া ছাত্রলীগের কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষ ও বেপরোয়া আচরণের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হইয়া আসিতেছে নিয়মিতভাবে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চট্টগ্রাম ও সিলেটে ছাত্রলীগের সংঘর্ষসহ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষ এবং ছাত্রলীগের সংঘর্ষে পাবনা মেডিক্যাল বন্ধ ঘোষণার খবর প্রকাশিত হইয়াছে প্রায় সকল পত্রপত্রিকায়। যদিও ছাত্রলীগ বা অন্যসকল অঙ্গসংগঠনের নেতারা সংগঠনটির বিভিন্ন সমালোচনার প্রেক্ষিতে বলিবেন যে, ইহা অতিরঞ্জন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কোনো অতিরঞ্জন দীর্ঘদিন ধরিয়া অব্যাহত রাখা যায় না। আর এই ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কীর্তির ব্যাপারে নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই।
অথচ ছাত্রলীগের ঐতিহ্য অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। সংগঠনটির স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের দিকে চোখ রাখিলে আমরা দেখিতে পাই ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর হইতে প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম সারিতে ছিল ছাত্রলীগ। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা ও পরে এগার দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ছিয়ানব্বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখিয়াছেন। এইসকল আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদ হইয়াছেন সংগঠনটির অসংখ্য নেতাকর্মী। কিন্তু সর্বশেষ ৯ বত্সরের ইতিহাস অন্যরকম। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, গত ৯ বত্সরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হইয়াছেন প্রায় ৬০ জন। অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নানা ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের মূলে রহিয়াছে সহজপথে কিংবা শর্টকাট উপায়ে অর্থ ও ক্ষমতার স্বাদ পাইবার বেপরোয়া মানসিকতা। ইহা সকল আমলেই দেখা যায়। বাস্তবতা হইল, এইসকল সংঘর্ষ হইতে ছাত্র সংগঠনকে নিরস্ত করিবার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান নহে। জাতির আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও গৌরবের প্রকাশ ঘটিত যেই ছাত্রলীগ লইয়া, সংগঠনটির সেই মর্যাদা এখন যে আর পূর্বের মতো অটুট নাই তাহা প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছেন সংগঠনটির অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী। প্রধানমন্ত্রী এবং দলের অনেক শীর্ষ নেতাও ছাত্রলীগের ভূমিকা লইয়া উষ্মা প্রকাশ করিয়াছেন বিভিন্ন সময়। কড়া ভাষায় সতর্ক করিবার পাশাপাশি ইহার ভাবমূর্তি রক্ষায় নানা দিক-নির্দেশনাও দিয়াছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে যেই ধরনের ঔষধে তাহাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের প্রশমন ঘটানো যাইতে পারে তাহা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত দেখা যাইতেছে না।
ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙাইয়া বাড়াবাড়ির ঘটনা যখন বিপজ্জনক পর্যায়ে চলিয়া যায়, তখন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রয়োজন হয় নূতন দৃষ্টান্তের। ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যাহাদের কারণে ধূলায় গড়াইতেছে তাহাদের চিহ্নিত করা নিশ্চয়ই কঠিন কাজ নহে। তাহাদের সামলাইতে হইবে এখনই।