নবজাতকের পুষ্টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারনা রাখেন না দেশের অর্ধেক মা-ই। আর এই অজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে। এসব অঞ্চলের ৪২ থেকে ৫২ ভাগ মায়ের নবজাতক শিশুদের পুষ্টিজ্ঞান কম। তারা জানেন না কখন শিশুদের বাড়তি খাবার দিতে হবে। শিশুর ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সে কী ধরনের বাড়তি খাবার খাওয়াতে হবে সে বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা পান না মায়েরা। তবে তুলনামূলক শহুরে মায়েরা একটু বেশি সচেতন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত মায়েরা বেশি সচেতন। শিশু পুষ্টি, নবজাতক শিশুর যত্নসহ মায়েদের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে করা একটি জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বিআইডিএস, ইউনিসেফ এবং পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বিভাগ যৌথভাবে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুর জন্মের ৩০ মিনিটের মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা মত দিলেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বা জ্ঞানের অভাবে অনেক মা-ই এটি করেন না। গ্রামে ৩৬ ভাগ ও শহরের ২৩ ভাগ মা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো দিকনির্দেশনা পান না। যারা দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান, তাদের মধ্যে ৭০ ভাগ মা জরিপকালে জানিয়েছেন যে, তারা জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ান। ২২ ভাগ মা জানিয়েছেন তারা এই ত্রিশ মিনিটের মধ্যে না খাওয়ালেও প্রথম দিন থেকেই শুরু করেন। চার ভাগ মা বাচ্চা জন্মের প্রথম মাসে তাদের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করেন।
যেসব শিশু ছয়মাস বয়সের আগে মাতৃদুগ্ধ পান করে, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার কম। এসব শিশু ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ার মতো অসুখে দ্রুত সেরে উঠতে পারে। অর্থাত্ তাদের মাঝে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি।
গ্রামীণ পর্যায়ে মাত্র ১৮ ভাগ শিশু জন্মের পর অন্তত পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খেয়ে থাকে, আর শহরাঞ্চলে এই হার ২৪ ভাগ। অর্থাত্ বেশিরভাগ শিশু ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই সহকারী অন্যান্য শিশুখাদ্য খেয়ে থাকে। তথ্যে দেখা যায়, ৬ মাস বয়সের আগেই শিশুদের পানি, গরু-ছাগলের দুধ, বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস, কৌটার দুধ খাইয়ে থাকেন। অঞ্চলভেদে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকার প্রায় ৭০ ভাগ, খুলনায় ৭২ ভাগ ও বরিশালে ৭০ ভাগ শিশুকে ছয় মাস বয়সের আগেই গুেঁড়া বা অন্যান্য দুধ খাওয়ানো শুরু করে। তবে রংপুর ও চট্টগ্রামে এই হার তুলনামূলক কিছুটা কম। গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী মায়েদের প্রতিদিন ভাত, ডাল, দুধ, মাংস, ডিম, সবজি, ভিটামিন এবং ফল-এরকম পাঁচ ধরনের খাবার গ্রহণ করছে, এমন তথ্য সংগ্রহে দেখা যায়, গ্রামীণ পর্যায়ে মাত্র ৩৫ ভাগ এবং শহর পর্যায়ে ৪৭ ভাগ এই খাবারগুলো নিয়মিত খাচ্ছে। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে এই খাবার পরিমাণমতো গ্রহণের হার তুলনামূলক কম। তবে শিক্ষিত মায়েদের মধ্যে পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণের হার বেশি লক্ষ করা গেছে। প্রসূতি মায়েদের সেবা শহর-গ্রামে বিস্তৃত হলেও এখন কিছু অঞ্চলে এই সেবায় ঘাটতি রয়ে গেছে। মায়েরা তাদের আবাসস্থল হতে ৩০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে এই সেবা কতটা পাচ্ছেন সেটিও জরিপে উঠে এসেছে। তথ্যে দেখা গেছে, যেসব মা তুলনামূলক শিক্ষিত তাদের প্রসূতি সেবা গ্রহণের হার বেশি। স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রসূতিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিচ্ছে। ফলে তাদের মাঝে গর্ভকালীন রক্তশূন্যতা রোধে আয়রন ও ফলিক এসিডের মতো ওষুধ গ্রহণের হারও বেড়েছে। তবে গর্ভকালীন শেষ সময়ে এখনো অর্ধেক মায়েরা এ ধরনের সেবার বাইরে রয়ে গেছে।
জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ : জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন নেওয়ার কথা থাকলেও চার ভাগের তিন ভাগ শিশু এই সময়ের মধ্যে নিবন্ধিত হচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ পরিবার জন্ম নিবন্ধনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।
ঝরে পড়া: শহরের তুলনায় গ্রামীণ পর্যায়ে স্কুলের শিশুরা বেশি ঝরে পড়ছে। অঞ্চলভেদে ৭ থেকে ১৭ ভাগ পর্যন্ত ঝরে পড়ছে। এর মূল কারণ হিসেবে শিশুশ্রম (৪১%), শিক্ষা ব্যয় নির্বাহ করতে না পারাসহ প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব না বুঝতে পারাকে দায়ী করা হয়েছে।
এইচআইভি/এইডস: ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে জরিপকালে দেখা যায় মাত্র ২৪ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৩৫ ভাগ শহুরে তরুণের মাঝে এইচআইভি ও এইডস বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রয়েছে।
সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন: নিরাপদ উত্স থেকে পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশে ৫৭ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী টিউবওয়েলের পানি পান করছে। তবে এর একটি বড় অংশ সবসময় এই উত্স থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারছে না।