বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের হুমকি দেয়ার প্রেক্ষিতে রাজনীতি টালমাটাল হয়ে উঠেছে। দলটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করছে। যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ না করেন, তাহলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বর্জন করতে পারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ যখন সহিংস হয়ে উঠেছে, তখন নির্বাচন বর্জনের এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির একজন নেতা। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে হবে শেখ হাসিনাকে, যাতে তার পদে একজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই সরকার আগামী জানুয়ারিতে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এসব কথা লিখেছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
এতে আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সাবেক মন্ত্রী এবং বিএনপির উচ্চপদস্থ নেতা আবদুল মঈন খান বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ভুয়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এই সরকার চাইছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে।
তাদের সেই ভুয়া নির্বাচনের উদ্দেশ্যকে আমরা বৈধতা দিতে পারি না। এর আগে এ বছরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। জনগণের অধিকারকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্য জনগণের দুর্দশা বাড়িয়েছে। গত রোববার তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
একই দিনে বিএনপি মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের জন্য মহাসড়ক, রেল ও পানিপথে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের ফলে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। এতে লোকজন নিহত হয়েছেন। বুধবার ছিল অবরোধের দ্বিতীয় দিন। এদিন রাজধানী ঢাকায় একটি স্কুলের সামনে বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। স্থানীয় মিডিয়ার খবর সন্দেহভাজন আরেকজন পলাতক রয়েছে। একদিন আগে পুলিশ ও বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষের সময় তিনজন নিহত হয়েছেন। ২৮শে অক্টোবর দু’জন পুলিশ সদস্য সহ কমপক্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশত। সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অনুপ্রবেশ করে সহিংসতা ঘটিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে বলা হয়েছে, ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশ চলাকালে সংঘটিত সহিংসতায় নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে সাত পৃষ্ঠার একটি চিঠি দিয়েছে বিএনপি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই সহিংসতার নেপথ্যে কারা তা জানতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করছেন বিএনপি নেতারা। জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে বিএনপি। যেহেতু দেশ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও জীবন ধারণের খরচ বৃদ্ধির অবনতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, তাই পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত একটি দ্রুত সমাধানে আসা।
সম্প্রতি বিক্ষোভকারীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহারের জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার বিষয়ক এজেন্সিগুলো। বুধবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেছেন, নির্বাচনে বিরোধীদের অংশগ্রহণ ও ভোটের অধিকারের বিরুদ্ধে সরকার অব্যাহতভাবে দমনপীড়ন চালাচ্ছে বলে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ে অনেক বাংলাদেশি আতঙ্কিত। যখন বিরোধীদের টার্গেট করা হচ্ছে, হয়রান করা হচ্ছে এবং জেলে ঢোকানো হচ্ছে, তখন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না একথাটা বলা উচিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উচিত এটা পরিষ্কার করে বলা যে, কর্তৃপক্ষ নির্বাচনে নিয়ম লঙ্ঘন করলে বাংলাদেশের সঙ্গে তারা স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য অব্যাহত রাখবে না। বিরোধীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার ও তাদেরকে টার্গেট করার নিন্দা জানাতে হবে। একই সঙ্গে বলতে হবে বাংলাদেশ যদি এই নির্যাতনের পথ থেকে ফিরে আসতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিণতিতে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে।
মঙ্গলবার সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সদস্য ফারুক খান ও দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মি আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বৃটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুক। তিনি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি এবং একসঙ্গে কাজ করতে সব দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার মঙ্গলবার বলেছেন, বাংলাদেশের বেশ কিছু অংশীদারের সঙ্গে সংলাপ চালাচ্ছে ওয়াশিংটন। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাংলাদেশে আমরা যা চাই, বাংলাদেশের মানুষও তাই চায়। তা হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা, জড়িত থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা সেপ্টেম্বরে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের হাই কমিশনারের অফিস থেকে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে যে, এমন সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য। এমন বিবৃতি বা কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, যা সহিংসতায় উস্কানি দেয়। ২৬শে অক্টোবর বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের কারাগারগুলো আমাদের নেতাকর্মীতে উপচে পড়ছে। বিএনপির অভিযোগ, এ বছর জুলাই থেকে তাদের কমপক্ষে ৫০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন শত শত মামলা দেয়া হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। জেলখানায় নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন বিএনপির বেশ কিছু নেতা। তাদের একজন শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি বলেছেন, আটক রেখে তাকে প্রহার করা হয়েছে।
আটক বন্দিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অশোভন আচরণের সব অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা করতে বলেছে।