ময়মনসিংহ বিভাগীয় ব্যুরো:- খাঁচায় থাকা দুটি ভালুকের মধ্যে একটির শরীরে পচন ধরেছে। প্রাণীটির পায়ের অংশবিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ক্ষতস্থানে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে হলুদের গুঁড়া। কিছুক্ষণ পর পর যন্ত্রণায় ছটফট করছে ভালুকটি। একপর্যায়ে আবার ঘুমোচ্ছে। শরীর দেখে বুঝা যায়, খুবই দুর্বল অবস্থায় পড়ে আছে সে।
এভাবেই ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে অবৈধভাবে মিনি চিড়িয়াখানা গড়ে তাতে বন্যপ্রাণী আটকে রেখে কষ্ট দেওয়া হচ্ছিল। অবশেষে এটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছে ২৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। বিকেলে ঢাকার বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কর্মকর্তারা চিড়িয়াখানাটি পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যার দিকে সিলগালা করে দেন।এসময় মিনি চিড়িয়াখানায় অবৈধভাবে রাখা একটি অজগর সাপ, দুটি ময়ূর, পাঁচটি হরিণ, দুটি মদনটাক পাখি, একটি কুমির, দুটি ভালুক, একটি সজারু, পাঁচটি বানর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ ২৭ প্রজাতির দেশিয় প্রাণী জব্দ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের দিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের জায়গা ভাড়া নিয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হয় এই মিনি চিড়িয়াখানা। তখন এটি সিটি করপোরেশন থেকে নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়েছিলেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ২ নম্বর প্যানেল মেয়র মাহবুবুর রহমান দুলালের শ্যালক সেলিম। পরে তার কাছ থেকে মাহবুবুর রহমান দুলাল এটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন।তখন থেকে এই চিড়িয়াখানাতে বিভিন্ন প্রাণীকে খাঁচায় বন্দি করে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট এবং বিভিন্ন রাইড স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসার প্রসার ঘটানো হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গাঢাকা দেন তারা। এরপর চিড়িয়াখানার দায়িত্ব নেন একই ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মামুন।সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আবুল কালাম আজাদ বলেন, শুরু থেকেই চিড়িয়াখানার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা নিয়ে দর্শনার্থীরা অসন্তুষ্ট ছিলেন। তবুও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা একটি ভালুকের পায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট পরিদর্শন করে সিলগালা করে দেওয়ায় আমরা খুশি। কারণ মিনি চিড়িয়াখানায় প্রাণিগুলো খুব কষ্টে ছিল।চিড়িয়াখানায় থাকা কামাল হোসেন নামে এক কর্মী বলেন, এখানে হরিণ, ভালুক, কুমির, হনুমান, গাধা, অজগরসহ ২৪ প্রজাতির প্রাণী আছে। তবে মেছো বাঘের মৃত্যুর পর বর্তমানে সেখানে ২৩ প্রজাতির ১১৪টি প্রাণী রয়েছে। ৩০ টাকায় টিকিট কেটে দর্শনার্থীরা চিড়িয়াখানাটিতে ঢুকতে পারেন।
চিড়িয়াখানার পরিচালক মিজানুর রহমান মামুন বলেন, নামমাত্র বিনিময় মূল্যে দর্শনার্থীরা এখানে প্রবেশ করেন। প্রাণীদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া হয়। তবুও একটি ভালুক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অসুস্থ হলে তার পায়ে পচন ধরে এবং ঘা হয়ে যায়। এটিকে সুস্থ করতে একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।বন্যপ্রাণী ও জীব বৈচিত্র্য কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, জব্দকৃত প্রাণীগুলোর মধ্যে কিছু প্রাণীকে গাজীপুরের সাফারি পার্কে রাখা হবে। বাকিগুলো অবমুক্ত করা হবে। এখন থেকে আর এই চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থী প্রবেশ করতে পারবেন না। অতিরিক্ত দুর্বল থাকায় এই মুহূর্তে অসুস্থ ভালুককে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একজন অধ্যাপক ভালুকটির নিয়মিত চিকিৎসা করবেন। যখন সুস্থ হবে তখন আমরা নিয়ে যাবো।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক নার্গিস সুলতানা জানান, বন্যপ্রাণী সংগ্রহ, দখলে রাখা, প্রদর্শন ও সংরক্ষণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশি-বিদেশি যে কোনো পশু-পাখির জন্যই এখানকার পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর। এরপরও নিয়ম বহির্ভূতভাবে চিড়িয়াখানাটিতে ৪৮টি দেশীয় প্রাণী ছিল। এর মধ্যে ২৭টি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। বাকিগুলো চিকিৎসার জন্য এখানেই থাকবে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সচিব সুমনা আল মজিদ বলেন, চিড়িয়াখানার জন্য সিটি করপোরেশন শুধু জমি বরাদ্দ দিয়েছে। সেখানকার প্রাণীর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয়। যদি প্রাণীদের সুরক্ষা দিতে না পারে ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে ইজারা বাতিলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।