পাবনা প্রতিনিধি॥
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। ৩০ নভেম্বর উদ্বোধন হতে যাচেছ বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনার রি আক্টও বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র) নির্মাণ কাজ। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি দুটি ভাগে নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়েছে। এখন চলছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে পাবনা জেলা প্রশাসন। পুরো প্রকল্প এলাকা গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে পাবনার সর্বস্তরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুই পর্যায় মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৪’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফরে গেলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের একটি ফ্রেম ওয়ার্ক চুক্তি হয়। প্রথম প্রস্তুতিমূলক এবং দ্বিতীয়ত মূল নির্মাণ কাজ। প্রকল্পের মূল নির্মাণ অর্থ্যাৎ পরমানণু চুল্লি তৈরির কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করবে ৩০ নভেম্বর। ২০২৩ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২১ সালেই প্রথম ইউনিট চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. শওকত আকবর প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের মূল স্থাপনার রি আক্টও বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র) নির্মাণ কাজ শুরুর দিনটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুতের ইতিহাসে উল্লেযোগ্য একটি দিন হবে। তিনি আরো জানান, ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই স্বাক্ষরিত হয় রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর (এক লক্ষ এক হাজার দুইশত কোটি টাকা) চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্থাপিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয়ের ১০ ভাগ নিজস্ব অর্থায়ন হতে এবং ১১.৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিবে রাশিয়া। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঋনের টাকা প্রদানের ১০ বছর পর হতে ৩০ বছরের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ হতে ঋণের প্রথম কিস্তি প্রদান শুরু হবে। প্রতিবছরের ১৫ মার্চ ও ১৫ সেপ্টেম্বর কিস্তিতে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। মুনাফার সাথে ১.৭৫ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হবে। তবে সুদের হার ৪ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়াতে ২৬ জুলাই এই প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাকি সদস্যরা হলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ হান্নান,ইআরডি’র সচিব মেজবাহ উদ্দীন,অতিরিক্ত সচিব আবুল মনসুর মো: ফয়জুল্লাহ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: আনোয়ার হোসেন।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. শওকত আকবর আরও জানান ,২০১৬ সালের ২১ জুন বাংলাদেশের পারমানবিক শক্তি রেগুলারেটি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনকে কেন্দ্র স্থাপনে সাইট লাইসেন্স প্রদান করে। এর পর ২৭ জুন মন্ত্রীসভা কমিটিতে এই ঋণ চুক্তির খসড়া অনুমোদিত হয়। রূপপুরে দেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য রাশিয়ার মস্কোয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পের বজ্য ফেরত নিয়ে যাওয়ারও চুক্তি হয়েছে।
এদিকে পশ্চিামাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এই রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হবে তিনশ ৩৯ কোটি টাকা। ঈশ্বরদীর বাইপাশ স্টেশনের টেক অফ পয়েন্ট হতে প্রকল্প পর্যন্ত এই রেলপথ নির্মিত হবে। প্রকল্পর নির্মাণের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্যই এই রেলপথ নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিকমিখাউল খোসলেভ জানান, ২০১৭ সাল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং মূল পারমাণবিক স্থাপনা তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাব বেইজ তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচেছ মূল প্রকল্পের ভিত্তিও। অবকাঠামো ছাড়াও অনেক কাজ চলছে। মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে তার পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তিনি আরো জানান, এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিঅ্যাক্টরন বসবে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি। যা কেবল রাশিয়ায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রয়েছে। বাংরাদেশের রূপপুরেই হবে এর দ্বিতীয় ব্যবহার। ২০২০ সালের মধ্যে রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ সব যন্ত্রপাতিই রাশিয়া থেকে আসবে। প্রকল্পের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের কারণে এবং রাশিয়ান ফেডারেশনে নির্মিত প্রযুক্তির অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দূর্ঘটনার ঝুঁকি নেই। এরপরও যদি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে কোন দূর্ঘটনা ঘটে তবে এর তেজস্ত্রিয় পদার্থ জনগণের নাগালের মধ্যে যাবে না। এরই মধ্যে মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিং করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়ে ছিল। কিন্তু তা পর্যাপ্ত ন হওয়ায় ইতিমধ্যে ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটিভরাটের কাজ। অন্যদিকে মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে তৈরি হচেছ গ্রীণ সিটি আবাসন পল্লী। পাবনা গণপূর্ত অধিদপ্তর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে তিনটি সুউচ্চ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা মোট ১১টি ভবন এবং ১৬ তলা আটটি ভবনের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। মোট ২২টি সুউচচ ভবন নির্মিত হবে। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শনে এসে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পাবনার রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমাদের গর্ব ,বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও আর্ন্তজাতিক পরমানবিক জগতে প্রবেশ করেছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে পাবনা জেলা প্রশাসন। পুরো প্রকল্প এলাকা গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাবনা জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রায় দিনই প্রস্তুতি সভা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে পাবনার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আনন্দ বিরাজ করছে।