শ্বেতপ্রদর আমাদের দেশেই সবারই জানা একটি নাম। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন- সাদা-স্রাব, প্রমেহ, মেহ ইত্যাদি। অনেকের ধারণা, শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়া কোন একটি রোগের নাম, কথাটি সত্য নয়। এ নামে কোন রোগ নেই। এটি একটি উপসর্গ মাত্র। যোনির নিঃসরণকেই শ্বতপ্রদর বা লিউকোরিয়া বলা হয়। বিভিন্ন কারণে শ্বেতপ্রদর হতে পারে এবং সেই কারণের উপরই নির্ভর করবে নিঃসরিত স্রাবের রং কি হবে? শ্বেতপ্রদরের অন্যতম ও প্রধান কারণ হচ্ছে যোনিপথের ইনফেকশন বা জীবাণু দূষণ, এমনকি সে ক্ষেত্রে যদি নিঃসরণ কোনরকম ইনফেকশন ছাড়াও ঘটে তবে তাকেও শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনও যদি হয় যে, যোনি ও জরায়ুগ্রীবায় ক্যান্সারের কারণে ও রক্তাভযোনি নিঃসরণ ঘটে তাকে ওলিউকোরিয়া ধরা হয়। উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লিউকোরিয়ার প্রধান কারণ ইনফেকশন। প্রধান যে দুটি জীবাণু লিউকোরিয়ার জন্য দায়ী তা হলো ট্রাইকোমনোস ভ্যাজিনালিস এবং ক্যানডিডা এলবিকাসন। দুটি রোগই যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়ায়। এর ভয়াবহতার গুরুত্ব বিবেচনা করে রোগ দুটিকে লঘু যৌনরোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও গার্ডনেরেলা ভাজিনালিস, মাইকোপ্লাসমা হোমিনিস, ইউরিয়াপ্লাসমা ইউরিয়া লাইটিকাস, গণোকক্কাস, ক্লামাইডিয়া, হারপিস সিমল্লেক্স ইত্যাদি জীবাণুর কারণে বিভিন্ন রকমের ও রঙের নিঃসরণ ঘটতে পারে। তবে এই প্রতিবেদনের মূলত প্রথম গুরুত্বপর্ণ দুটো জীবাণুর ওপরেই আলোচনা সীমিত রাখা হবে।
ক্যানডিডিয়াসিস : এর আরেকটি নাম মনিলিয়াসিস এবং এ রোগ যে ছত্রাক জীবাণুু দিয়ে হয় সে জীবাণুটির নাম ক্যানডিডা এ্যালবিকাসন। অতি প্রাচীন এ রোগ। তবে এ জীবাণু আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৩৯ সালে। যে বিজ্ঞানী এটি আবিষ্কার করেন তার নাম ল্যানজেনাবেক। এই জীবাণুগুলো মুখ, গলা, বৃহদন্ত এবং যোনিপথে সচরাচর সংক্রমণ ঘটায়। তারা ভেজা এবং গরম স্থানে অতি সহজেই আক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। তবে শুষ্ক স্থানে (ত্বকে) তারা কখনই আক্রমণ ঘটায়। তারা ভেজা এবং গরম স্থানে অতি সহজেই আক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। তবে শুষ্ক স্থানে (ত্বকে) তারা কখনই আক্রমণ ঘটাতে পারে না। তাই তারা মুখ থেকে শুরু করে ফুসফুস, যোনি, ভেজা ত্বকে বা চামড়ার ভাঁজ, অন্তনালী ইত্যাদি স্থানে সংক্রমিত হয়। এটা নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সংক্রমিত হয়ে থাকে।
পুরুষের ক্ষেত্রে উপসর্গ : পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা যন্ত্রণা অনুভূত হয়। প্রসাবের পথে চুলকানি এবং সাদা পদার্থের নিঃসরণ– যা পরিমাণে খুবই কম হয়ে থাকে। পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের নালীর অগ্রভাগে লক্ষ্য করলে প্রদাহজনিত লালচে ভাব দেখা যায়। মহিলাদের অনেক ক্ষেত্রেই এ রোগের কোন উপসর্গ থাকে না। যাদের থাকে তাদের সাদা স্রাব বা অন্য রঙের যোনি নিঃসরণ, যোনিপথের চুলকানি, প্রস্রাবের পথে জ্বালা যন্ত্রণা, কারও কারও ক্ষেত্রে সহবাসের সময় ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। যোনিপথ পরীক্ষা করলে প্রদাহের কারণে ফোলা লালচে ভাব দেখা যায় এবং ভিতরে যে নিঃসরণ দেখা যায় তা পানির মতো এমনকি চুনের মতো দেখা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয় : এ ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে ছত্রাক নির্ণয় করা যায় ঠিকই, তবে সাধারণত তা করা হয় না। রোগের উৎস বা লক্ষণ শুনেই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। একটা কথা জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, এই জীবাণু আমাদের দেহে বিশেষ করে গলা, মুখে বৃহদন্ত্রে, যোনিপথে, পরজীবী হিসেবে কোনরকম ক্ষতি করা ছাড়াই মানব দেহে বসবাস করে। তবে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা হলে, ডায়াবেটিস্ দেখা দিলে কার্টিসোন গ্রুপের ওষুধ সেবন করলে, স্বাস্থ্যহীনতা ও দুর্বলতায় ভুগলে, বেশি পরিমাণ এন্টিবায়োটিক খেলে, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে খাবারে বেশি পরিমাণ সুগার খেলে দেহের অভ্যন্তরে (বৃহদন্ত্রের) নিষ্ক্রিয় জীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আবার আমাদের দেহে ত্বরিত আক্রমণ ঘটায়।
ট্রাইকোমোনিয়াসিস : এই রোগের জীবাণুটির নাম ট্রাইকোমোনাস্ ভ্যাজিনালিস্। ভ্যাজিনালিস্ শব্দটি শুনলে মনে হয় যেন ভাজিনা থেকে এসেছে ভ্যাজিনালিস্ শব্দটি। সেই কারণে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যেন এ রোগ বুঝি শুধু মহিলাদের হয়। আসলে কিন্তু সেটা নয়। নারী-পুরুষ উভয়ের এ রোগটি হতে পারে। এ জীবাণু দেখতে ডিম্বাকৃতির এবং শ্বেতকণিকার চেয়ে কিছুটা বড়। এই জীবাণুটি যোনিপথ ছাড়াও কিডনিতন্ত্রের নিচের অংশে আক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এটিও অন্যান্য যৌন রোগের মতো সহবাসের মাধ্যমে একের থেকে অপরের দেহে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত রোগীর অন্তর্বাস ব্যবহার করলেও সংক্রমিত হতে পারে। জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৪ থেকে ১২ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
উপসর্গ : অধিকাংশ আক্রান্ত পুরুষের ক্ষেত্রে এ রোগের কোন উপসর্গ থাকে না। অনেকের ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ মূত্রনালী নিঃসরণ থাকতে পারে। প্রস্রাবের রাস্তায় সামান্য পরিমাণ জ্বালা-যন্ত্রণাও থাকতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনির নিঃসরণ যা পাতলা থেকে শুরু করে হলদে রঙের হতে পারে। যোনিপথের চুলকানি, তলপেটের ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং জ্বালা যন্ত্রণা ও এক সঙ্গে থাকতে পারে। এ রোগটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সাহায্য ছাড়াই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। তবে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে রোগটি শনাক্ত করা যায়।
চিকিৎসা : এ ক্ষেত্রে অন্যান্য যৌন রোগের মতই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই একসঙ্গে চিকিৎসার প্রয়োজন। ট্যাবলেট মেট্রোনিডাজল ২৫০ মিঃগ্রাম রোজ ৩ বার ০৭ দিন পর্যন্ত দিতে হবে। অথবা একসঙ্গে ২ গ্রাম মেট্রোনিডাজল অর্থাৎ ৪০০ মিঃগ্রামের সাড়ে ৪টি বড়ি এক সঙ্গে খেতে হবে। ক্যানডিডা এ্যালবিকাসনের ক্ষেত্রে ক্লোট্রিমাজল ১% ভ্যাজিনার ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্লোট্রিমাজল ভ্যাজিনাল ট্যাবলেট রোজ ২ বর ৬দিন পর্যন্ত ব্যবহার করলেও খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
লেখক : চর্ম, এলার্জি ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : গ্রীন সুপার মার্কেট, গ্রীন রোড
– See more at: http://www.dailyjanakantha.com/details/article/312029/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE-%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE#sthash.7cu7LIrh.dpuf