ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসাকে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া ওয়াসাকে তিনি নানা অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। এমন অভিযোগ তুলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে গতকাল লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা। এ প্রসঙ্গে ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা ওয়াসায় বর্তমানে অনিয়ম-দুর্নীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি কোনো নিয়ম-কানুন মানেন না। ওয়াসা বোর্ডকেও তিনি কোনো পাত্তা দেন না। সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় তিনি ওয়াসা চালাচ্ছেন। এ বিষয়টিই আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আশা করি তারা এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দেবেন। এ প্রসঙ্গে জানতে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে একাধিকবার ফোন করা ও মোবাইলে মেসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
জানা যায়, ওয়াসার চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা গতকাল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে ‘ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সাথে অসহযোগিতা, অসদাচরণ ও পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন ১৯৯৬ এর বিধি অমান্যকরণ প্রসঙ্গে’ দেয়া অভিযোগে তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সাথে অসহযোগিতা, ওয়াসা আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা, ঢাকা ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা এবং ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননা দীর্ঘ দিন থেকে চলে এলেও বর্তমানে তা চরমপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তারই প্রমাণস্বরূপ কয়েকটি ঘটনার প্রতি আপনার সদর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এই পরিস্থিতিতে বোর্ডের করণীয় সম্পর্কে আপনার দিকনির্দেশনার প্রত্যাশা করছি।
লিখিত অভিযোগে ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেন, ‘পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৮৬ এর ধারা ১১ (১) মতে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বোর্ডসভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ধারা ১১ (২) এ বলা আছে ‘বোর্ডের সভা চেয়ারম্যান অথবা তার অবর্তমানে ভাই চেয়ারম্যান কর্তৃক আহূত হবে। ধারা ১১(৯)এ বলা আছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ডের যেকোনো সভায় যোগদান করতে পারবেন, কিন্তু কোনো ভোট দিতে পারবেন না।’
অভিযোগে ওয়াসা চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘৩০২তম বোর্ড সভা হয়েছিল গত ১৫ মার্চ। গত ১৬ এপ্রিল এমডির অনুরোধে তার চাওয়া এজেন্ডা অনুযায়ী ৩০৩তম বোর্ডসভা আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু ওই দিন সভার একটু আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাতের সূচি আছে বলে তিনি বোর্ডসভা স্থগিতের অনুরোধ জানান। ফলে সভা করা সম্ভব হয়নি। এরপর তিনি দেশের বাইরে জার্মানি যান। যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করলে বলেছিলাম, স্থগিতকৃত ৩০৩তম সভা দেশে ফেরার পরে ১৪ থেকে ১৮ মে সুবিধামতো যেকোনো দিনে করতে হবে। এরপর আমাকে কানাডার অবস্থানরত আমার মেয়ের কাছে তার বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হবে। এ দিকে এমডির বিদেশে অবস্থানকালীন আমি ঢাকা ওয়াসার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একাত্তর টিভিতে খোলামেলা বক্তব্য রাখি। সেখানে আমি যা বলেছি সব সত্য বলেছি এবং ঢাকা ওয়াসাকে বাঁচাতে এসব কথা বলার প্রয়োজন আছে। এরপর এমডি সাহেব বিদেশে অবস্থান করে ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, জোরপূর্বক চেয়ারম্যানের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেয়া ইত্যাদি করতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে মেয়াদোত্তীর্ণ অবৈধ (এমডি কর্তৃক মনোনীত) বিভিন্ন সমিতিকে দিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করান।
দেশে ফেরার পর তিনি আর বোর্ডসভার কথা বললেন না। এ দিকে ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ধারা ১১(১) মতে প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বোর্ডসভা করার বাধ্যবাধকতার কারণে ১৫ মে’র আগেই ৩০৩তম সভা করার প্রয়োজন দেখা দিলো। এ অবস্থায় আমি ১১(২) ধারায় চেয়ারম্যানের ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ওয়াসা বোর্ডের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৭ মে বুধবার বিকেল ৪টায় ওয়াসা ভবনের বোর্ডরুমে ৩০৩তম বোর্ডসভা আহ্বান করি এবং এমডি ও ওয়াসার সচিবকে সদস্যদের সশরীরে উপস্থিতিতে সভা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে বলি। কিন্তু ওয়াসার এমডি বা সচিব আমার দেয়া নোটিশ পড়েও সভা আয়োজনের কোনো ব্যবস্থা করেননি, যা বোর্ডকে অবমাননা ও অসদাচরণের শামিল এবং এর মাধ্যমে তারা দু’জনই ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ধারা ১১ (১) উপেক্ষা করেছেন।’
অভিযোগপত্রে চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, ‘ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের নিজস্ব কোনো সচিবালয় নেই। কোনো কর্মকর্তাও নেই। বোর্ড সচিব নামে কোনো পদও অর্গানোগ্রামে নেই। ঢাকা ওয়াসার সচিব পদে পূর্বে সরকার থেকে প্রেষণে একজন কর্মকর্তা আসতেন। এমডি তাকসিম এ খান কায়দা করে তাকে গ্রহণ না করে বেআইনিভাবে নিজের আজ্ঞাবহ একজন প্রকৌশলীকে (যার প্রবিধান মতে এ পদের কোনোই যোগ্যতা নেই) এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে রেখে দিয়েছেন। তাকেই আবার বেআইনিভাবে বোর্ড সচিব বলে থাকেন। এই সচিবকে এমডি অনেক দায়িত্ব¡ দিয়ে রেখেছেন। বলা হয় তিনি প্রশাসনের প্রধান। অথচ ঢাকা ওয়াসায় একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন ডিএমডি (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) আছেন। তিনি স্বউদ্যোগে অনেক কাজ শুরু করায় এবং বেশ কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় এমডি তাকে সাইডলাইনে রেখে দিয়েছেন, এমনকি ভুয়া অভিযোগ তুলে তাকে বরখাস্ত করার চেষ্টাও করেছেন। কারণ এমডি বুঝতে পেরেছেন যে তিনি তার আজ্ঞাবহ হবেন না। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান সচিব বোর্ড-চেয়ারম্যান বা বোর্ড সদস্য কারো কাজ করেন না। তাকে ডেকেও পাওয়া যায় না। এমডি অফিসে না থাকলে তিনিও থাকেন না। তা ছাড়া তিনি তো এমডির ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মতো কাজ করেন। বোর্ডের কাজ তাকে দিয়ে করানো যায় না। আগে যখন সরকার থেকে প্রেষণে ওয়াসার সচিব আসতেন, তখন বোর্ড কাজ করতে পারত। এ পদ্ধতিটি আবারো চালু করা জরুরি মনে করছি।’
ওয়াসা চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, ‘আমি বারবার বোর্ড সভায় বোর্ডের দুইজন নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি এমডি তাকসিম এ খান এর টালবাহানার কারণে। এভাবেই এমডি তাকসিম এ খান নিজের অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখাতে বোর্ডকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজের সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করে রেখেছেন। তিনি বলেন, তিনি বোর্ডেরও প্রধান নির্বাহী। তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। তার অনিয়ম-অপশাসনের ফিরিস্তি বড় লম্বা যা এখানে লেখা সম্ভব না। আইনে পরিষ্কার উল্লেখ থাকলেও তার বিদেশে ছুটিতে অবস্থানকালীন বোর্ড সভা করতে তিনি বাধা দিয়েছেন। তার চাহিত এজেন্ডা ছাড়া বোর্ড সভা হবে না এমন দাবির মুখে বোর্ড সদস্যদের সাথে অনেক বাগি¦তণ্ডা হয়েছে। তার পরও এখনো তিনি সেই পথেই হাঁটেন। ঢাকা ওয়াসার বাজেটে তিনি কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন আইটেমে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছামতো বাজেটবহির্ভূত খরচ করেন। বোর্ড কোনো আইটেমের বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার পরও আগামী বছরের বাজেটে বোর্ড সদস্যরা এবার অনেক খরচ কমিয়ে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা লাভ দেখিয়েছেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য বোর্ডকে বাইপাস করে ঢাকা ওয়াসাকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করা।’
গোলাম মোস্তফা অভিযোগ করেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যেই তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকেই তিনি চাকরি থেকে অপসারণ করেন। অতীতে এ ধরনের ঘটনা শত শত। চাকরি হারানোর ভয়ে তাই কেউ মুখ খোলে না। একটি সরকারি সংস্থা এভাবে চলতে পারে না। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়া ঠেকাতে ১৫ বছর আগে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশী ঋণ নিয়ে পানি শোধনাগার নির্মাণ শুরু করলেও এখন পর্যন্ত শতকরা ৭৫ ভাগই ভূগর্ভের পানির ওপর ওয়াসা নির্ভরশীল। এ সময়ে গভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। প্রকল্প শুরু হয় তো আর শেষ হয় না। খরচ বেড়ে হয় আকাশচুম্বী। এসব নিয়ে এমডির মাথা ব্যথা নেই। তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকায় নির্মিত পদ্মা পানি শোধনাগার তিন বছর ধরে অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। বোর্ড থেকে নিজস্ব অর্থায়নে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা খরচ করে তিন বছরে ঢাকার এক দিকে প্রয়োজনীয় ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন নির্মাণ করতে বললেও এমডি তাতে কান দেন না। অথচ পানির অভাবে এ বছর লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পেয়েছে ও পাচ্ছে।’
ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতির চিত্র ভয়াবহ। এ সম্পর্কে না হয় পরে বলব। বর্তমানে জনবল আউটসোর্সিং এ চলছে লঙ্কাকাণ্ড। এমডির আশপাশের লোকেরা নিজেরা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জনবল সংগ্রহ করে কনট্রাক্টরের নামে পোস্টিং নেয়। যে সংখ্যক আউটসোর্সড স্টাফকে বেতন দেয়া দেখানো হয়, বাস্তবে আছে তার চেয়ে অনেক কম। বারবার বলা সত্ত্বেও জনবল আউটসোর্সের বিষয়টি বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হয় না। এত সমস্যার মধ্যে ঢাকা ওয়াসা চললেও বোর্ডের যেন কিছুই করণীয় নেই। বোর্ডকে বাইপাস করে বোর্ডের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলছে ঢাকা ওয়াসা।
গোলাম মোস্তফা বলেন, এমডি তাকসিম এ খান শুধু পানির মূল্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো প্রয়োজন নেই। অনিয়ম, অপচয় আর লুটপাট কমিয়ে আনলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। তা ছাড়া ওয়াসা বোর্ডের একজন সদস্য হিসাব করে প্রমাণ করেছেন, পানির উৎপাদনের যে খরচ দেখানো হয় তা ভুল। এসব নিয়ে বোর্ডে আলোচনা করতেও আগ্রহী নন এমডি।
এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ওয়াসা বোর্ডের সদস্যদের সাথে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছেন চেয়ারম্যান। তবে ওই সভায় এমডি তাকসিম এ খানকে রাখতে চান না তারা। এ ছাড়া ওয়াসায় বর্তমান অবৈধ ভারপ্রাপ্ত ওয়াসা সচিবের পরিবর্তে সরকার থেকে প্রেষণে একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
লিখিত অভিযোগ বিষয়ে ওয়াসা চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, লিখিত অভিযোগে যা লিখেছি এমডির তার থেকে অনেক বেশি অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। এ জন্য বাধ্য হয়েই বোর্ডের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ করা হয়েছে।
জানা যায়, সম্প্রতি ওয়াসা চেয়ারম্যান একটি বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিয়ে ওয়াসা এমডির বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরেন। এরপর গত ১১ মে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ওয়াসা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়।