• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৪ অপরাহ্ন

শ্যাম্পুর খালি বোতলে বাঁচবে শিশুর প্রাণ! ডায়রিয়ার ওরস্যালাইনের মতো নিউমোনিয়া চিকিত্সায় ‘বাবল সিপিএপি যন্ত্র’ যুগান্তকারী আবিষ্কার

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৭

একটি শ্যাম্পুর বোতল এবং কিছু প্লাস্টিকের নল (বাবল সিপিএপি যন্ত্র) বাঁচিয়ে দিতে পারে লাখো শিশুর জীবন? নিউমোনিয়া হলে শিশুদের ফুসফুস প্রয়োজনীয় মাত্রায় অক্সিজেন নেয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের তখন নিঃশ্বাসে সাহায্য করতে পারে একটি ভেন্টিলেটর। যার খরচ ১৫ হাজার ডলার। কিন্তু এই বাবল সিপিএপি যন্ত্রের দাম মাত্র ১.২৫ ডলার। ডায়রিয়ার ওরস্যালাইনের মতো নিউমোনিয়া চিকিত্সায় ‘বাবল সিপিএপি যন্ত্র’ একটি যুগান্তকারী আবিস্কার। আগে ডায়রিয়া কিংবা কলেরা হলো মৃত্যু ছিল অবধারিত। এখন খাবার স্যালাইন আবিস্কারের ফলে কেউ আর ডায়রিয়ায় মারা যায় না। তেমনি স্বল্প মূল্যের এই বাবল সিপিএপি যন্ত্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে দিবে। গবেষণার পর ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের চিস্তি এই যন্ত্র আবিস্কার করেছেন। যন্ত্রের মূল অংশটি হলো শ্যাম্পুর খালি বোতল। এই যন্ত্র এ পর্যন্ত ৬০০-র বেশি বাচ্চাকে বাঁচতে সাহায্য করেছে।

এই যন্ত্রটির মাধ্যমে শিশুরা একটি ট্যাঙ্ক থেকে নিঃশ্বাসের জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং প্রশ্বাসের জন্য তাদেরকে একটি টিউব দেয়া হয় যার অপর প্রান্ত একটি বুদবুদ উত্পাদনকারী পানির বোতলে ঢুকানো থাকে। এর কারণ বুদবুদ থেকে উত্পন্ন চাপ ফুসফুসের ছোট বায়ুকোষ্ঠ গুলো খুলে রাখে। বাংলাদেশে এই যন্ত্রটি পরীক্ষা করে ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু আটকানো সম্ভব হয়েছে। ডা. চিস্তি আশা করছেন, এই যন্ত্র ব্যবহার করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সকল শিশুর জীবন বাঁচানো যাবে। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে ডা. জোবায়ের চিস্তি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘শিক্ষাধীন চিকিত্সক হিসাবে আমার প্রথম রাত। চোখের সামনেই দেখেছিলাম তিনটি বাচ্চার মৃত্যু। এত অসহায় মনে হয়েছিল যে, নিজে কেঁদেই ফেলেছিলাম।’

গতকাল বিবিসি বাংলায়ও এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে ডা মোহাম্মদ জোবায়ের চিস্তি কাজ করছিলেন বাংলাদেশের সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে। সেই থেকে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, নিউমোনিয়া থেকে শিশুদের বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। প্রতি বছর প্রায় ৯ লাখ ২০ হাজার শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়। দুই দশকের গবেষণার পর ডা. চিস্তি এবার নিয়ে এসেছেন একেবারেই সস্তা একটি উপায় যা লাখো বাচ্চার জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।

ডা. চিস্তি জানান, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় ফুসফুস। স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া কিংবা শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) সংক্রমণ ঘটায় ফুসফুসে যা ফুলে ওঠে, ভরে ওঠে পুঁজে বা তরল পদার্থে, যা অক্সিজেন গ্রহণ করে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করানো হয়। কিন্তু সেই যন্ত্রগুলোর প্রতিটির দাম ১৫ হাজার ডলার এবং যন্ত্রগুলি চালানোর জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন। যার ফলে গোটা ব্যাপারটা অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি সাতজনে একটি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে কাজ করার সময় ডা. চিস্তি একটি বুদবুদ তৈরির সিপিএপি যন্ত্র দেখেছিলেন। যন্ত্রটি ফুসফুসে নিয়মিত বায়ুর যোগান দিয়ে ইতিবাচক চাপ তৈরি করে যাতে ফুসফুস কাজ করা থামিয়ে না দেয়। শরীরেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছয়। কিন্তু সেই যন্ত্রটিও বেশ দামী। কর্মসূত্রে যখন ডা. চিস্তি ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশের ডায়রিয়া অসুখের চিকিত্সা সংক্রান্ত গবেষণার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি’তে, তখন থেকেই তিনি কাজ করতে শুরু করেছিলেন সহজ, সস্তা একটি বাবল সিপিএপি যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে। এক সহকর্মীর সঙ্গে তিনি কাজ করছিলেন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ফেলে দেওয়া একটি প্লাস্টিকের শ্যাম্পু বোতল নিয়ে। প্রথমে তাতে পানি ভরে অন্যপ্রান্তের খানিকটা প্লাস্টিকের অংশ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন অন্য একটি টিউবে। শিশুরা অক্সিজেন টেনে নেয় একটি জলাধার থেকে এবং নিঃশ্বাস ছাড়ে একটি টিউবের মাধ্যমে যা ডোবানো থাকে একটি পানির বোতলের মধ্যে, যার ফলে বাতাসে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। বুদবুদ থেকে সৃষ্ট চাপ ফুসফুসের মধ্যে ছোট বায়ুথলিগুলিকে খুলে রাখতে সাহায্য করে। চার-পাঁচটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর ওপর পরীক্ষা করে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আশাতীত উন্নতি দেখতে পান তিনি।

যন্ত্রটি তৈরি করতে চিকিত্সকদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। উল্লিখিত চিকিত্সায় সুস্থ হয়েছেন কোহিনূর বেগমের কন্যা রুনা। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে কোহিনূর বেগম জানান, ‘অক্সিজেন পাঠানোর নল, শরীরে খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি নল এবং সাদা গোল একটি বোতল যুক্ত করা হচ্ছিল বাইরে যেখানে বুদবুদ তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গে। চিকিত্সা শেষে যখন বাচ্চা সেরে গিয়েছিল, খুব খুশি হয়েছিলাম।’

দু-বছর পড়াশোনার পর ডা. চিস্তি তার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন দ্য ল্যান্সেট পত্রিকায়। তাঁর পরীক্ষায় দেখা যায়, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের যন্ত্রের মাধ্যমে অল্পমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের চেয়েও এই বাবল সিপিএপি যন্ত্রের মাধ্যমে চিকিত্সা করিয়ে শিশু মৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব এবং সেটাও মাত্র ১.২৫ ডলার বা ১ পাউন্ড খরচে। যন্ত্রটি ব্যবহারে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যাচ্ছিল ৭৫ শতাংশ। আর এই নতুন যন্ত্রটি অক্সিজেনের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি দক্ষতা দেখিয়েছিল যা বুঝিয়ে দিয়েছিল হাসপাতালে অক্সিজেনজনিত খরচের পরিমাণ – আগে বছরে যেখানে ৩০ হাজার ডলার খরচ হচ্ছিল, এই যন্ত্রের ব্যবহারে তা নেমে এসেছিল ৬০০০ ডলার বা ৪ হাজার ৬০ পাউন্ডে।

এদিকে আইসিডিডিআরবিতে ডা. চিস্তি এখন ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বিভাগের প্রধান। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিটি হাসপাতালে তিনি এই সিপিএপি যন্ত্রটি দেখতে চান। হাসপাতালগুলো যাতে এই যন্ত্রটি সুলভে পেতে পারে তার ব্যবস্থাও করবেন ডা চিস্তি। এই যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নিউমোনিয়ায়  আক্রান্ত শিশু মৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে পৌঁছাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আইসিডিডিআরবি’র চিফ ফিজিশিয়ান ডা. আজহারুল ইসলাম খান ইত্তেফাককে জানান, বাবল সিপিএপি যন্ত্র ডা. চিস্তির সফল আবিস্কার। বাংলাদেশে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এটি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ইথুপিয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন জানান, বাবল সিপিএপি যন্ত্র নিউমোনিয়া চিকিত্সায় নতুন আবিস্কার। এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিউমোনিয়া নির্মুল সম্ভব। তিনি বলেন, পরিসংখ্যন না থাকলেও দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকার ইতিমধ্যে ইটিআই কর্মসূচির সঙ্গে নিউমোনিয়া নির্ভুল ভ্যাকসিন সংযুক্ত করেছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ