২০২০ সালের নীতিমালা বাতিল করে নতুন বিধিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য ‘ড্রোন বিধিমালা, ২০২৫’র খসড়া করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, ২৫০ গ্রামের বেশি ওজনের বা এর নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যাপ্তি ৬০ মিটারের ঊর্ধ্বে হলে ওই ড্রোনের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হচ্ছে। তবে কোনো ড্রোনের ওজন ২৫০ গ্রামের কম কিন্তু অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস থাকলেও বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে নিবন্ধন।
বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী, ৫ কেজির বেশি ওজনের ড্রোন ওড়ানোর ক্ষেত্রে নিবন্ধন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আগে ড্রোনকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হলেও বিধিমালায় শ্রেণি করা হচ্ছে তিনটি। নীতিমালার মতো বিধিমালায় অননুমোদিতভাবে ড্রোন ওড়ানোর জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
ড্রোন নিয়ে এখন যেটি আছে তা নীতিমালা। আমরা নীতিমালার পরিবর্তে বিধিমালা করছি। সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তনও আসছে। তবে কী থাকছে তা চূড়ান্ত হওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না।- বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশন) আব্দুন নাসের খান
বিশ্বব্যাপী কৃষিকাজ ও কৃষির উন্নয়ন, আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ এবং পরিবেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, ফসলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মশার ওষুধ বা কীটনাশক স্প্রে, বিভিন্ন প্রকার সার্ভে, চিত্র ধারণ ও চলচ্চিত্র নির্মাণ, জরুরি সাহায্য পাঠানো, গবেষণা কার্যক্রম, নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ কাজে আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিক্যাল (ইউএভি) বা আনম্যান্ড এয়ারক্র্যাফট সিস্টেম (ইউএএস) বা রিমোটলি পাইলটেড এয়ারক্র্যাফট সিস্টেম (আরপিএএস) বা ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশেও ব্যক্তিগত সরকারি-বেসরকারি বা সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলোর ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং দেশের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায়ও এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত কাজে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বা নিরাপত্তা ভঙ্গ এবং জনসাধারণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতির মতো অনৈতিক, বেআইনি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপে এ প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ‘ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন বিধিমালা, ২০২০’ জারি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, নীতিমালায় অনেক বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এ নীতিমালা প্রয়োগেও সমস্যা হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে নতুন বিধিমালা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশন) আব্দুন নাসের খান বলেন, ‘ড্রোন নিয়ে এখন যেটি আছে তা নীতিমালা। আমরা নীতিমালার পরিবর্তে বিধিমালা করছি। সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তনও আসছে। তবে কী থাকছে তা চূড়ান্ত হওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না।’
মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সিভিল অ্যাভিয়েশন) অনুপ কুমার তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের পরামর্শে ড্রোন পরিচালনা নিয়ে নীতিমালাটি বিধিমালায় পরিবর্তিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে বিধিমালাটি হবে।’
তিনি বলেন, ‘খসড়া বিধিমালার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত পেয়েছি। এখন সেগুলো পর্যালোচনা করছি। এরপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকে ড্রোন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে।
ড্রোনের শ্রেণি
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়ার সুবিধার্থে ব্যবহারের ভিত্তিতে ড্রোনকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হচ্ছে।
খেলনা জাতীয় ড্রোনকে ‘ওপেন’, খেলনা জাতীয় ড্রোন ছাড়া অন্য সব ড্রোনকে ‘স্পেসিফিক’ এবং মানুষ ও পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত ড্রোনকে ‘সার্টিফায়েড’ শ্রেণিতে ভাগ করা হচ্ছে।
বিদ্যমান নীতিমালায় ড্রোনকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা ড্রোনকে ক-শ্রেণি। শিক্ষা ও গবেষণার মতো অবাণিজ্যিক কাজে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তির ব্যবহার করা ড্রোন খ-শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
ড্রোন-খেলনা বিমান ওড়ানোর ৪৫ দিন আগে অনুমতি নিতে হবে: আইএসপিআর
জরিপ, স্থিরচিত্র, চলচ্চিত্র নির্মাণ, পণ্য পরিবহনের মতো বাণিজ্যিক ও পেশাদার কাজে ব্যবহার করা ড্রোন গ-শ্রেণি এবং রাষ্ট্রীয় বা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত ড্রোন ঘ-শ্রেণির মধ্যে পড়েছে।
নিবন্ধন
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, ওপেন ক্যাটাগরির ড্রোন প্লেলোডসহ (সেন্সর, স্টোরেজ, ব্যাটারি) ২৫০ গ্রামের বেশি ওজনের বা এর নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যাপ্তি ৬০ মিটারের ঊর্ধ্বে হলে এবং ২৫০ গ্রামের নিচে কোনো ড্রোনে অডিও বা ভিডিও বা যে কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস থাকলে ওই ড্রোনের নিবন্ধনও বাধ্যতামূলক।
২৫০ গ্রামের বেশি ওজনের সব ড্রোন পরিচালনার জন্য ড্রোন চালকদের বেবিচক নির্ধারিত পদ্ধতিতে ড্রোন উড্ডয়নের সার্টিফিকেট বা প্রত্যয়ন নিতে হবে বলে জানানো হয়েছে খসড়ায়।
স্পেসিফিক ও সার্টিফায়েড ক্যাটাগরির ড্রোনের ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এয়ার নেভিগেশন অর্ডারে (এএনও) নির্ধারিত ফর্মে ও পদ্ধতিতে আবেদন করে ড্রোনের নিবন্ধন বা পরিচিতি নম্বর গ্রহণ করতে হবে।
বিদ্যমান নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণির ড্রোন বেবিচকের এএনও-তে নির্ধারিত ফর্মে ও পদ্ধতিতে আবেদন করে ড্রোনের নিবন্ধন বা পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। ‘ক’শ্রেণির ড্রোন ১০০ ফুটের (৩০ দশমিক ৪৮ মিটার) বেশি উচ্চতায় উড্ডয়ন ক্ষমতাসম্পন্ন হলে বা ৫ কেজির বেশি ওজনের হলে ওই ড্রোনের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।
জোন
বিদ্যমান বিধিমালার মতো নতুন বিধিমালায়ও বিমান ও জনসাধারণের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ড্রোন ওড়ানোর জন্য গ্রিন, ইয়েলো ও রেড (সবুজ, হলুদ ও লাল) জোন থাকছে। তবে ড্রোনের ক্যাটাগরি অনুযায়ী উড্ডয়নের শর্তে আসছে পরিবর্তন।
বেবিচক-এর এএনও এবং ড্রোন অ্যাপসে জিওফেন্সিংয়ের মাধ্যমে এ জোনগুলো সুনির্দিষ্ট করা থাকবে।
ইয়েলো এবং রেড জোন ছাড়া বেবিচক নির্ধারিত অন্য সব এলাকা গ্রিন জোনের অন্তর্ভুক্ত। এ এলাকায় ওপেন শ্রেণির ড্রোনের জন্য ভূমি থেকে ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট পর্যন্ত উড্ডয়নের জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন হবে না। বর্তমান নীতিমালায় বলা হয়েছে, গ্রিন জোনে ড্রোন ওড়াতে কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই।
কঠোর হচ্ছে সব ধরনের ড্রোন ওড়ানোর নিয়ম
ইয়েলো জোনের মধ্যে রয়েছে- বিমানবন্দরের কেন্দ্রের কাছাকাছি ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা, কেপিআই ও তৎসংলগ্ন চতুর্দিকে ৫০০ মিটার, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, জনসমাগমপূর্ণ এলাকা যথা- নগর ও শহর এলাকা, উপজেলা সদর, বাজার, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (কর্মঘণ্টার সময়কালীন), ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সভা-সমাবেশ, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খেলা বা ইভেন্ট ও উৎসবকালীন জনসমাগম ইত্যাদি। ইয়েলো জোনে ড্রোন উড্ডয়নের ক্ষেত্রে বেবিচকের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হবে। বর্তমান নীতিমালায় সংরক্ষিত এলাকা, সামরিক এলাকা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, জনসমাগমপূর্ণ এলাকা ইয়েলো জোনের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে খসড়া অনুযায়ী বিমানবন্দর কেন্দ্র থেকে ৩ কিলোমিটার এলাকা, নিষিদ্ধ এলাকা, সংরক্ষিত এলাকা, সামরিক এলাকা, বিপজ্জনক এলাকা, বিশেষ কেপিআই ও তৎসংলগ্ন চতুর্দিকে ১ কিলোমিটার, আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে দেশের অভ্যন্তরে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত রেড জোন। রেড জোনে ড্রোন উড্ডয়নের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বা অন্য কোনো বিশেষ বাহিনীর (এসএসএফ) অনাপত্তি সনদ সাপেক্ষে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বেবিচক বিশেষ অনুমতি দেবে।
বর্তমান নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ এলাকা, বিপজ্জনক এলাকা, বিমানবন্দর, কেপিআই, বিশেষ কেপিআই রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে এ জোনে ড্রোন পরিচালনা করা যাবে।
খেলনাজাতীয় ড্রোন ছাড়া অন্য ড্রোন চালকের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে খসড়া বিধিমালায়।
এক্ষেত্রে ড্রোন চালকের সর্বনিম্ন বয়স হতে পারবে ১৬ বছর। ড্রোন চালক শারীরিক মানসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ অবস্থায় ড্রোন পরিচালনা করবেন এবং এ ব্যাপারে বেবিচক নির্ধারিত শর্ত বা নির্দেশনা অনুসরণ করবেন। কোনো চালক কোনো ড্রাগস ব্যবহারের আট ঘণ্টার মধ্যে কোনো ড্রোন নিজে উড্ডয়ন বা পরিচালনা বা ওড়ানো কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবেন না বলে বিধিমালায় জানানো হয়েছে।
খসড়া বিধিমালায় ড্রোন উড্ডয়নের সাধারণ শর্তাবলি উল্লেখ করা হয়েছে।
নীতিমালার মতো বিধিমালায়ও ড্রোন বা ড্রোনের যন্ত্রাংশ আমদানি, তৈরি ও সংযোজনে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
ওপেন ক্যাটাগরি ছাড়া সরকারের আমদানি নীতিমালা অনুসারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তি সাপেক্ষে ড্রোন বা ড্রোনের যন্ত্রাংশ আমদানি করা যাবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে খেলনাজাতীয় ড্রোন ছাড়া অন্য ড্রোন এবং ড্রোনের যন্ত্রাংশ তৈরি ও সংযোজন কারখানা স্থাপন করতে হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ খেলনাজাতীয় ড্রোন ও ড্রোনের যন্ত্রাংশ তৈরি এবং সংযোজন কারখানা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া ওপেন ক্যাটাগরি ছাড়া বাকি সব শ্রেণির ড্রোনের ক্ষেত্রে ড্রোন বা ড্রোনের যন্ত্রাংশ আমদানির আগেই ড্রোন বা ড্রোনের যন্ত্রাংশের বিস্তারিত স্পেসিফিকেশন ও সংখ্যা উল্লেখসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিতে হবে বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।