• মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:৩৭ অপরাহ্ন

ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সেশনজটের শঙ্কায়

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ অমান্য, যথাসময়ে ইনকোর্স ও সেমিস্টার পরীক্ষা না নেওয়া, ফল প্রকাশে অবহেলা ও শিক্ষক সংকটসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। ফলে সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালে অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষ করেছেন ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, আরবি, পালি অ্যান্ড বুদ্দিস্ট স্টাডিজসহ ২০-২১ শিক্ষাবর্ষের বেশকিছু বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এমনকি চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে অষ্টম সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়ে অনার্সের ইতি টানতে যাচ্ছেন ঢাবির উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কিছু বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার সময়সূচিও প্রকাশিত হয়েছে। তারা ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ৭ম সেমিস্টার শেষ করবে।

অন্যদিকে, একসঙ্গে ভর্তি হওয়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৯ মাস পর রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) পঞ্চম সেমিস্টারের ফল হাতে পেলেন। শুধু তাই নয়, গত আট মাসেরও বেশি সময় ধরে ষষ্ঠ সেমিস্টারের ক্লাস চললেও শেষ হয়নি ইনকোর্স। এর মধ্যে কোনো শিক্ষক একটি মিডটার্ম পরীক্ষাও সম্পন্ন করেনি।

সেই হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ছয় মাস থেকে এক বছর পিছিয়ে আছে সামাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু, ইতিহাস, লোকপ্রশাসনসহ অনেক বিভাগে পরবর্তী (২১-২২) শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা এখন ষষ্ঠ সেমিস্টারে ক্লাস করছেন। এ নিয়ে ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

দ্রুত পঞ্চম সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশ, ষষ্ঠ সেমিস্টারের তারিখ ঘোষণা নিয়ে রীতিমতো বিভাগের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে কয়েকদফায় বিভাগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লিখিত আবেদনও দেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা যায়।

বিভাগের এমন ধীর গতির ফলে ক্যারিয়ার ও চাকরিজীবনে প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা করছেন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার না মানা, নিয়মের অবহেলা ও শিক্ষকদের আন্তরিকতায় ঘাটতির ফলে এমন চিত্র দেখা দিয়েছে।

মানা হচ্ছে না ‘লস রিকভারি প্ল্যান’

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের সেশনজট কমাতে ছয় মাসের সেমিস্টার পাঁচ মাস করার পরিকল্পনা নেয় বিশ্ববিদ্যালয়। জুলাই অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যাতে সেশনজটে না পড়ে সেজন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ নিয়ম মানছে না বিভাগটি।

অভ্যুত্থান পরবর্তী শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল মিডটার্মের জন্য নির্ধারিত মিড উইকের মধ্যেই পরীক্ষা নেওয়া। তবে প্রতিশ্রুতির কয়েক মাসের মাথায় বিভাগকে সেটাও বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি।

করোনাকালীন সৃষ্ট সেশনজট কাটিয়ে উঠতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় ‘লস রিকভারি প্ল্যান’। এতে ছয় মাসের সেমিস্টার চার মাসে এবং এক বছরের ইয়ার আট মাসে করার কথা বলা হয়। তবে এখানেও নিয়ম না মেনে অন্যান্য সেমিস্টার ছয় মাসে এবং ষষ্ঠ সেমিস্টার ৮ মাস ধরে চলমান রয়েছে। ফলে কার্যত অন্যসব বিভাগ থেকে পিছিয়ে পড়েছে বিভাগটি।

শিক্ষক সংকট চরমে

বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৬টি ব্যাচে (২০১৮-১৯ থেকে ২৩-২৪ সেশন) প্রায় ১১০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। অন্যদিকে বিভাগের মোট শিক্ষক রয়েছেন ২৭ জন। তবে এর মাঝে ‘স্টাডি লিভ’ ও ‘ডিউটি লিভে’ আছেন ৬ শিক্ষক। জুলাই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বয়কটের শিকার হয়েছেন ৬ জন। তাছাড়া, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এই বিভাগ থেকেই নিয়োগ পেয়েছেন ২ জন শিক্ষক। আবার, চারজন অনারারি ও সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপকের মাঝে ক্লাস নেন মাত্র ১ জন। ফলে বিভাগের প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ৫টি ব্যাচে মাত্র ৮ জন শিক্ষক ক্লাস নিয়ে থাকেন।

এই ৮ শিক্ষকের মধ্যে একজন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, একজন বিভাগের চেয়ারম্যান, একজন হল প্রভোস্ট এবং একজন সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ক্লাস নিচ্ছেন। তাছাড়া, বিভাগে প্রায় ৮ বছর ধরে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

বিভাগটিতে সর্বশেষ ২০১৭ সালে বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিভাগটিতে কোনো প্রভাষক নেই। অন্যদিকে, বিভাগে ২ জন সহকারী অধ্যাপক থাকলেও উভয়েই স্টাডি লিভ নিয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

যা বলছেন শিক্ষার্থীরা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শেখ মুজিবুর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা একই সেশনের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছি। প্রথম বর্ষে একই সময়ে ক্লাস শুরু করলেও অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ছয় মাস পিছিয়ে রয়েছি। কোনো কোনো ডিপার্টমেন্টের তুলনায় এক বছর পিছিয়ে রয়েছি। বিভাগটিতে বর্তমানে সেশনজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। চার বছরে অনার্স ও এক বছরে মাস্টার্স শেষ করার কথা থাকলেও কোনো ব্যাচই তা সময়মতো শেষ করতে পারছে না।

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বিভাগে শিক্ষক সংকট সমস্যা প্রকট। শিক্ষক সংকটের কারণে কতিপয় শিক্ষক একইসঙ্গে অনেকগুলো কোর্সের ক্লাস নিচ্ছেন। এ কারণে, শিক্ষকরা সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা নিতে পারছেন না। ডিপার্টমেন্ট ঘোষিত সেমিস্টার রোডম্যাপ ফলো করতে পারছেন না। মিড-উইক কার্যত অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। পটপরিবর্তনের পরে ডিপার্টমেন্ট সংস্কারে বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাবনা দেওয়া হলেও তার বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ ক‍্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সময়মতো অনার্স শেষ করতে না পারলে কোনো চাকরির পরীক্ষাতে অংশগ্রহণ করতে পারব না।

বিভাগের অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, যথা সময়ে গ্রাজুয়েশন শেষ না হওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছি না। করোনার সময়ে আমাদের কালক্ষেপণ হয়েছে যা আমাদের গ্রাজুয়েশন এর জন্য যে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয় তা থেকে অনেক পিছিয়ে। আমরা আবেদন জানিয়েছি বিভাগ যেন ২০২৫ এর ডিসেম্বর এর মধ্যেই আমাদের গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে।

আগে থেকেই পিছিয়ে, দাবি বিভাগের

এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের আগ থেকেই এই ব্যাচ পিছিয়ে ছিল বলে দাবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেসময় বিভাগের শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল এই বিভাগের শিক্ষকরা। ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দিক সামলে অন্য বিভাগগুলোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে পারেনি বিভাগটি।

৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আসে। বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিনাত হুদাকে শিক্ষার্থীরা বয়কট করলে তার স্থলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল।

যা বলছে প্রশাসন

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বলেন, এই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই পিছিয়ে ছিল। নতুন প্রশাসন এসে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এই ব্যাচকে এগিয়ে নিতে।

তিনি বলেন, আমরা নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে অনবরত কাজ করে যাচ্ছি। খাবারের সময়ও আমরা পাচ্ছি না। মাত্র ৮ জন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্ব, আমি চেয়ারম্যান এবং একজন প্রভোস্ট এবং একজন সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। সব মিলিয়ে শিক্ষকদের অনেক চাপ গেলেও তারা রাত-দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বলেন, আমাদের শিক্ষক সংকট রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালের দিকে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। একসময় আমাদের বিভাগে ৩২ জন শিক্ষক ছিল। এখন আছে ২৭ জন। কিন্তু সবমিলিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন মাত্র ৮ জন শিক্ষক। নতুন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হলে এই সংকট কমবে।

শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ইয়ার গ্যাপ যাবে না উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, বিভাগের সিনিয়ররাও (১৯-২০ সেশন) অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আমরা দ্রুত পরীক্ষা নেওয়ায় তারা ৪৭ বিসিএস দিয়েছে। আমার শিক্ষার্থীদের (২০-২১ সেশন) হতাশার কারণ নেই। আশা করি তারা কোনো প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষা মিস করবে না। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।

সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রাশেদা ইশরাদ নাছির বলেন, বিভাগের রেজাল্ট আটকে আছে আমি শুনেছি। এ বিষয়ে আমি ভালো করে বলতে পারব না। বিভাগের চেয়ারম্যান এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন৷

শিক্ষক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের বেশকিছু কারণে শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিভাগের মাত্র ৮ জন শিক্ষক ক্লাস নেন। একদিনে তো সংকট সমাধান করা যাবে না, বিভাগে নতুন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

ঢাবির উপ-উপাচার্য শিক্ষা অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আমার কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়নি। আমার কাছে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলে আমি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে বিভাগকে অবহিত করতে পারব।

শিক্ষক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে নতুন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাই কিছুদিন সময় লাগছে। আশা করি, বিভাগটি দ্রুতই নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এই সংকট সমাধান করবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ