• বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ পূর্বাহ্ন

শত প্রতিবন্ধীকে স্বাবলম্বী করে চলেছেন ৩৯ ইঞ্চির অদম্য হোসনা

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫

মীর বাবুল ময়মনসিংহ:-জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী হোসনা আক্তার। উচ্চতা ৩৯ ইঞ্চি। হেঁটে চলাচল করতে কষ্ট হয় তার। চেয়ারে বসতে কিংবা কোনো যানবাহনে উঠতে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। নিজের এমন শারীরিক জটিলতায় অন্য প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছেন তিনি।

হোসনা আক্তার ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চর কালিবাড়ি এলাকার কুদরত আলী ও আলেয়া বেগম দম্পতির মেয়ে। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হোসনা দ্বিতীয়। জন্মগতভাবে হোসনা শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটাতে চেষ্টার কমতি নেই তার। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ছুটে বেড়ান প্রতিবন্ধীদের খোঁজে। তাদের একত্রিত করে গড়ে তুলেছেন ‘অগ্রণী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন। প্রতিবন্ধীরা মিলে হোসনাকে বানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদরের চর ঈশ্বরদিয়া, চর নিলক্ষীয়া ইউনিয়নসহ সিটি করপোরেশনের ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে ৮ শতাধিক প্রতিবন্ধী। বাসায় শুয়ে-বসে খাওয়া ছাড়া পরিবারের জন্য কিছুই করার ছিল না তাদের। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার উদ্যোগ নেন হোসনা। সরকারি-বেসরকারিভাবে পাওয়া সব ধরনের সহায়তা এসব প্রতিবন্ধীদের হাতে পৌঁছে দেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব নারীদের করছেন দক্ষ। ফলে অনেকে হচ্ছেন স্বাবলম্বী।

এতেও ক্ষান্ত নন হোসনা। এলাকা ঘুরে ঘুরে করেন বৃক্ষরোপণ। এভাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় বিভাগীয় পর্যায়ে অদম্য নারী সম্মাননা পুরস্কার ২০২৪ ও ময়মনসিংহ সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার অর্জন করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, হোসনা নিজে প্রতিবন্ধী হয়ে অন্য প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়িয়ে পরিচিতি পেয়েছেন। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাজুড়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেন। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য নানা দিকনির্দেশনাসহ সরকারি বেসরকারি সহায়তা তুলে দেন। অনেকে সেলাই মেশিনে রোজগার করা টাকায় নিজের খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারের ভরণপোষণ করছেন।

স্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তোফাজ্জাল হোসেন বলেন, হোসনা তার ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে এগিয়ে যাওয়া এক সফল নারী। সে প্রতিবন্ধী নারীদের সেলাই মেশিনের কাজ, বাটিকের কাজ শেখানোর পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও এলাকায় করেন বৃক্ষরোপণ। আমরা তার এমন কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানাই।

সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাকপ্রতিবন্ধী কারিনা আক্তার। তার বাবা নেই। তাকেসহ এক সন্তান ফেলে চলে যান স্বামী। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে সময় যাচ্ছিল তার। এমতাবস্থায় হোসনা তাকে সেলাই মেশিনের কাজ শেখান। বর্তমানে কারিনা তার বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে যে টাকা রোজগার করছেন তা দিয়েই চলছে সংসার।

কারিনার মা জায়িদা বেগম বলেন, আমার স্বামী নেই। আমার মেয়েরও স্বামী নেই। এমতাবস্থায় ঠিকমতো তিনবেলা খাবার জুটতো না। মেয়ে সেলাই মেশিনের কাজ শিখেছে। এখন সে সারাদিনে যা রোজগার করে তা দিয়েই সংসার চলে।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মালেকা খাতুন বলেন, পরিবার অবহেলা না করলেও একসময় নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করতাম। হোসনা আমাদের বাড়িতে এসে সেলাইয়ের কাজসহ বাটিকের কাজ শিখতে উৎসাহ দেয়। তার কথামতো কাজ শিখে এখন টাকা রোজগার করতে পারছি।

কথা হয় অদম্য নারী হোসনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার জীবন পথে চলার শুরুটা ছিল অনেক কঠিন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল আমার সব সমস্যার প্রধান। সবার মতো স্বাভাবিক জীবন ছিল না, বিধায় সবার সঙ্গে মিশে পড়ালেখা করতে পারিনি। তাই ঘরে সব সময় চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতাম। আমার সঙ্গে মা-বাবাকেও সামাজিক অনেক হয়রানির শিকার হতে হতো। আমি অন্য সবার চেয়ে গঠনমূলকভাবে অনেক ছোট বিধায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতাম না। আমার উচ্চতা মাত্র ৩৯ ইঞ্চি।

তিনি বলেন, পরিবারের সবাই কোথাও গেলে আমি সঙ্গে যেতে দ্বিধাবোধ করতাম। সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, আর্থ-সামাজিক নির্যাতনের কথা ভুলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করতে আমাকে সাহায্য করেছিল ‘প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার’। তাদের সহায়তা আর পরামর্শে আমি নিজেকে ঘরের বাইরে উপস্থাপন করতে শুরু করি। বর্তমানে আমি নতুন করে পড়ালেখা শুরু করেছি। আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা বয়স কোনোটাই আমার পড়ালেখা আটকে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আমি আমার স্বামীর সহযোগিতায় চলাফেরা করি। আমার স্বামীও একজন প্রতিবন্ধী। আমাদের একটি কন্যা সন্তান আছে।

হোসনা বলেন, পিসিসি মহিলা ক্লাব থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। নিজে দক্ষ হয়ে অন্য প্রতিবন্ধী নারীদের দক্ষ করতে চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত ১৬০ জনের বেশি প্রতিবন্ধী নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। আমি ডিপিও কর্মী হিসেবে চর ঈশ্বরদিয়া ও চর নিলক্ষীয়া ইউনিয়নে উইমেন ইন্টিগ্রেটেড সেক্সুয়াল হেলথ (উইস টু অ্যাকশন) নামে Handicap International এর একটি প্রকল্পে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত নারী ও কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। বর্তমানে access Bangladesh Foundation এর সঙ্গে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধী যুব নারী-পুরুষ প্রশিক্ষণ প্রদান বিষয়ক প্রকল্প পরিচালনা করার সমঝোতা স্মারক করেছি। বর্তমানে সদরের চর ঈশ্বরদিয়া, চর নিলক্ষীয়া ইউনিয়নসহ সিটি কর্পোরেশনের ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৮৩৪ জন প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।

শুধুমাত্র সবার ইতিবাচক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থান বদলে দিতে পারে উল্লেখ করে এই অদম্য নারী বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অবহেলিত নয়। তারাও দেশের সম্পদ। শুধুমাত্র সব মানুষ প্রতিবন্ধীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টি দিলে বদলে যেতে পারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থান।

হোসনার বাবা কুদরত আলী বলেন, এক সময় আমার এই মেয়ে ঘর থেকে বের হতে চাইত না। লজ্জা পেতো। ইচ্ছে শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে আমার মেয়ে অন্যদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। মেয়ের এমন মানবিক কাজে আমি বাবা হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে মা আলেয়া বেগম বলেন, মায়ের কাছে সব সন্তান সমান। হোসনাকে কখনোই আলাদা চোখে দেখিনি। তার মেধা ভালো। অন্য প্রতিবন্ধী নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সমাজে ভালো কাজ করছে। তাকে ছোটরা সম্মান করে, বড়রা স্নেহ করে। এমন দৃশ্য দেখে মা হিসেবে আনন্দ পাই।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ময়মনসিংহের পরিচালক নাঈমা হোসেন বলেন, সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় নির্বাচিত ৩৯ নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ পাঁচজন অদম্য নারীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। সমাজ উন্নয়নে হোসনা আক্তার সংবর্ধনা পেয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে তার জন্য গর্বের। হোসনা আক্তার এভাবেই আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছি।

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, নারী-পুরুষ সবাইকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সমাজে ভালো কাজে অংশীদার হতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ