দাউদকান্দি(কুমিল্লা) প্রতিনিধি॥
প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট সুত্র মৃত্যুর দু’বছর সময়ে এটা নিশ্চিত করেছেন, সন্দেহভাজন সম্ভাব্য সবাইর জিজ্ঞাসাবাদ এখনো শেষ হয়নি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের সন্মান শ্রেনীর শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু। লেখা-পড়ার পাশাপাশি থিয়েটার, নাচ-গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে ছিল তার যোগাযোগ। সেনানিবাস এলাকায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছিল তার সরব উপস্থিি দেশের অন্যতম চাঞ্চল্যকর সোহাগী জাহান তনু হত্যা’র আজ দু’বছর পূর্ণ। ২০১৬ সালের ২০মার্চ সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টার মাঝে কোন এক সময় কিছু মানুষরূপি নরপশুর হাতে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে তনু খুন হয়েছিল। এরপর মামলা,মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন,দু’দফা লাশ ময়নাতদন্ত, পরিবারের লোকজনসহ সামরিক, বেসামরিক অসংখ্য মানুষের জিজ্ঞাসাবাদ, নিহতের পরিবারকে তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রকৃত আসামীদের খুঁজে বের করা, ন্যায় বিচারের আশ্বাস কোন কিছুতেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারায় নিহতের পরিবারের লোকজন অনেকটাই হতাশ। পরিবারের কাছে যখনই জানতে চাওয়া হয় কেমন আছেন বা মামলার অগ্রগতির কোন খবর। তখন পাল্টা পরিবারের হতাশাজনক উত্তর আসে তদন্ত কর্মকর্তা বা বিভিন্ন জনের প্রশ্নের উত্তর আর গোয়েন্দা নজরদারীতে আমরা বড় ক্লান্ত। তনু’র মা’র উক্তি, গত দু’বছরে জেলখানার মতো বসবাস করছি আমরা । নাম ত। ফলে ময়নামতি সেনানিবাসসহ আশপাশের এলাকায় পরিচিত মুখ এই তনু। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ। প্রতিদিনের মত সেদিন বিকেলে বাসা থেকে বের হয় তনু। গন্তব্য পাশের সেনাবাহিনীর ১২ ইঞ্জিনিয়ারিং ষ্টাফ কোয়ার্টার ও ৬ বীর ষ্টাফ কোয়ার্টার। যেখানে সার্জেন্ট জাহিদ ও সিপাহী জাহিদের বাসা। উদ্দেশ্য তাদের শিশু সন্তানদের পড়ানো। একই সময় বাসা থেকে মা আনোয়ারা বেগম তনু’র চাচাতো বোন লাইজুকে নিয়ে বের হয় ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় মার্কেটে কাপড় সেলাই করতে। প্রাইভেট পড়ানো শেষে নিত্য তনু সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার মাঝে বাসায় ফিরলেও সেদিন তনু’র মা মার্কেট থেকে এসে মেয়ের অনপুস্থিতিতে অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কল করে তনু’র মোবাইল ফোনে। কিন্তু সাড়া মেলেনি ওপর প্রান্ত থেকে। এভাবে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়। রাত ১০ টায় বাসায় ফিরে বাবা ইয়ার হোসেন। মেয়ের ফিরে না আসার খবরে ফোন করে এমপি ইউনিটে। এরপর তিনিও বের হন মেয়েকে খুঁজতে। এবার সন্তানের খোঁজে প্রতিবেশী এক স্কুল শিক্ষক শিকদার মোস্তফা কামাল তার সাথী হন। বাসা থেকে কিছু দুওে প্রথমে নজওে আসে তনু’র সেন্ডেল, কিছুটা দুরে মোবাইল ফোন, নিরাপত্তা পাস সবশেষ রাত প্রায় সাড়ে ১১ টায় সেনানিবাসের পাওয়ার হাউজ এলাকায় (কালো পানির ট্যাংক) ঝোঁপের পাশে মিলে তনুর দেহ। চিৎকারে সেখানে ছুটে আসে কর্পোরাল আলমগীর, আনিসুজ্জামান, সার্জেন্ট মহসিন। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ময়নামতি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক লেঃ কর্নেল সেলিনা পরীক্ষা শেষে তনুকে মৃত ঘোষনা করেন। এসময় সেখানে ময়নামতি সেনানিবাসের ষ্টেশন কমান্ডারসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। ২১ মার্চ ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের গ্রামের বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা গ্রামে দাফন করা হয়। বাবা ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামী উল্লেখ কওে কোতয়ালী থানায় মামলা করেন। ময়নামতি সেনানিবাস সংলগ্ন নাজিরাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আইসি এসআই সাইফুল ২১ মার্চ প্রথম পরে ২৬ মার্চ ডিবি,২৯ মার্চ সিআইডি’র ওসি গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম তদন্তের দায়িত্ব পায়। সিআইডি কর্মকর্তা দায়িত্ব পেয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন আদালতে। ৩১ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তের প্রথম দফা রিপোর্টে চিকিৎসক নিহতের মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে ব্যর্থ হন। এরপর ওই একই বছরের ২৬ আগষ্ট আবারো তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তণ করা হয়। এবারে দায়িত্বপান সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার)। পরিবার থেকে শুরু করে নিহতের সহপাঠি,বন্ধু-বান্ধব, সামরিক বিভিন্ন পদমর্যাদার লোকজন,ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কাউকেই বাদ দেয়নি জিজ্ঞাসাবাদে। নিহতের পরিবারের সদস্যদের একাধিকবার সিআইডি’র ঢাকা কার্যালয়েও ডেকে পাঠানো হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়,সিআইডি ডিএনএ ল্যাবে পরীক্ষায় পৃথক ৩ ব্যক্তির বীর্যের আলামত পেয়েছিল। ফলে তদন্তকারী সংস্থার লোকজন এটা নিশ্চিত হয়েছেন, হত্যার আগে তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এছাড়াও তার চুল লম্বা থাকলেও মৃত্যুর পর তনুর চুল ছোট পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সুত্র আরো জানায়,ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার আলামত নষ্ট করায় সংশ্লিস্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এদিকে নিহতের মা আনোয়ারা বেগম ঘটনার পর থেকে সার্জেন্ট জাহিদ, সিপাহী জাহিদ ও সার্জেন্ট তাজুলকে হত্যায় জড়িত সন্দেহে একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তাসহ গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, সেনানিবাসের অনুষ্ঠানে যোগদান না করায় তার মেয়েকে মেরে ফেলা হয়। তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন বলেন, সম্ভাব্য অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। উল্লেখিত ৩জনও ছিল এর মাঝে। তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমাদের সম্ভাব্য আসামীরা এখন কেউ এখানে কর্মরত নেই। সবাইকে অন্যত্র বদলী করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি, আমার স্বামী ইয়ার হোসেন, ছেলে রুবেল, নাজমুল, চাচাতো বোন লাইজু, গ্রামের বাড়ি বাঙ্গরায় আরো কয়েকজন আতœীয়কে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ বার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কুমিল্লা সিআইডি অফিস,বাসা ও ঢাকা সিআইডি অফিসে। তিনি বলেন, আমাদেরকে পুরোপুরি নজরদারীতে রাখা হয়েছে। গত দু’বছর ধরে জেলখানায় বসবাস করছি। কি করি,কোথায় যাই,মোবাইলে কার সাথে কথা হয় সব কিছুই নজরদারী করছে গোয়েন্দারা। নজরদারীর পাশাপাশি মোবাইল ট্রেকিংয়ের অভিযোগও রয়েছে তার। মামলার কোন অগ্রগতি না হওয়ায় তনু’র পরিবারে হতাশা নেমে এসেছে। ৩ মাস ধরে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন অসুস্থ্য। আর্থিক টানপোড়নে দু’ছেলে রুবেল, নাজমুল হন্য হয়ে চাকুরীর সন্ধানে ঘুরছে। মৃত্যুর দু’বছর সময়ে মা আনোয়ারা বেগম জানান, তার শেষ ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা কওে তনু হত্যার বিচার চাওয়া। তিনি দেশবাসী, সরকারের কাছে বিচার দাবী করেন। উল্লেখ্য কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় ক্যান্টবোর্ড অফিসের এলএমএস পদে মালী হিসেবে ২০০০ সালে যোগদান করেন ইয়ার হোসেন। তার সংসারে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম, দু’ছেলে রুবেল ও নাজমুল আর এক মেয়ে সোহাগী জাহান তনু। এখানে কাজে যোগদানের পরপরই পরিবারের উল্লেখিত সদস্যদেও নিয়ে সরকারী বাসায় বসবাস শুরু করেন। ২০১২ সালে ক্যান্টবোর্ড স্কুল থেকে এসএসসি ২০১৪ সালে ময়নামতি সেনানিবাস সংলগ্ন কোটবাড়ি ক্যান্টবোর্ড স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজে সন্মান শ্রেনীতে ভর্তি হন। সবশেষ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে নির্মমভাবে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। মামলার সামগ্রিক অগ্রগতির বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন বলেন, নিহতের পরিবারের দেয়া সন্দেহভাজনদেরসহ এপর্যন্ত ৫০’এর বেশী সামরিক অফিসার, সিপাহীসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার লোক ছাড়াও নিহতের পরিবারেরসদস্যসহ কমপক্ষে ৬০জন বেসামরিক লোককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সম্ভাব্য আরো কয়েকজন এখনো বাকী রয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদে। তিনি আশাবাদী দ্রুত মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছেন ।