চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মাঝেচর এলাকায় সারবাহী জাহাজে সাতজন খুনের ঘটনাটি ডাকাতি বলা হলেও স্বজনদের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মরদেহে ‘আলামত’ দেখেই এমন দাবি তাদের।
পুলিশও এই ঘটনাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গে মরদেহ শনাক্তের জন্য আসা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এই অভিমত পাওয়া যায়।
গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে ঘটনাস্থল থেকে নোঙর করা জাহাজে পাঁচজনের মরদেহ পাওয়া যায়। তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে তাদের মধ্যে আরও দুজন মারা যান। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত অবশ্য মামলা হয়নি।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের স্বজনদের মধ্যে অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সোমবারের সুরতহাল এবং ময়নাতদন্তের ভিত্তিতে কাজ করছে নৌপুলিশ।
যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার, তারা হলেন জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, সুকানি আমিনুল মুন্সী, লস্কর শেখ সবুজ (৩৫), লস্কর মো. মাজেদুল (১৬), লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬), ইঞ্জিনচালক মো. সালাউদ্দিন (৪০) ও বাবুর্চি কাজী রানা (২৪)।
এদের মধ্যে গোলাম কিবরিয়া ফরিদপুর জেলা সদরের জোয়াইর গ্রামের মৃত আনিছ বিশ্বাসের ছেলে; শেখ সবুজ তারই আপন ভাগ্নে এবং একই গ্রামের মৃত আতাউর রহমানের ছেলে; আমিনুল মুন্সী নড়াইল জেলার লোহাগড়া তানার ইটনা ইউনিয়নের পাঙ্খারচর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেল; মো. মাজেদুল মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার মো. আনিছুর রহমানের ছেলে; সজিবুল ইসলাম একই উপজেলার পলাশবাড়িয়া গ্রামের দাউদ হোসেনের ছেলে; মো. সালাউদ্দিন নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লাহোরিয়া ১১ নলি গ্রামের মৃত আবেদ মোল্লার ছেলে; আর কাজী রানা মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামের কাজী দেলোয়ার হোসেনের ছেলে।
লস্কর শেখ সবুজের ছোট ভাই সাদিকুর রহমান বলেন, ‘জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া আমার মামা। তার মাধ্যমেই আমার ছোট ভাই সবুজ জাহাজে আসেন। তিনি লস্কর হিসেবে কাজ করেন। একদিন আগে আমার সঙ্গে ভাইয়ের কথা হয়েছে। যে মর্মান্তিক ঘটনায় আমার ভাই হত্যার শিকার হয়েছে, আমি চাই এমন ঘটনা যেন কারও ভাগ্যে না ঘটে। এই জাহাজে থাকা প্রত্যেকটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। ঘটনাটি যেন কেউ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা না করে, আমি এটিও দাবি করছি।
একই দাবি জানান জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার ভাই আউয়াল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই মাসেই আমার ভাইয়ের চাকরির মেয়াদ শেষ হতো। তিনি ১ জানুয়ারি থেকে অবসরে যেতেন। ওনার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের জানুয়ারি মাসে বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু এই ঘটনার পরে সব পকিল্পনাই যেন শেষ। ’
ডাকাতির ঘটনা ঘটলে জাহাজে লুটপাট হতো, মারামারিতে হত্যাকাণ্ডের জখম ভিন্ন ভিন্ন হতো। কিন্তু যারা খুন হয়েছেন, তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও জাহাজে পাওয়া গেছে, এমনকি প্রত্যেকের খুন হওয়ার ধরনও একই।
সুকানি আমিনুল মুন্সীর বড় ভাই মো. হুমায়ুন ও ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিনের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, ঘটনাটি তারা ডাকাতি শুনলেও আলামত দেখে মনে হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যা। কারণ নিহত প্রত্যেকের মাথায় ধারলো অস্ত্রের আঘাত। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন সবারই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পাওয়া গেছে। এমনকি জাহাজে থাকা পাঁচজনকে উদ্ধারের সময় তাদের শোয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জুয়েল নামে একজনের গলা ও শ্বাসনালী কাটা ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। আর সজিবুল ও মাজেদুলকে যখন মৃত অবস্থায় আনা হয়, তখন তাদের মাথায় ও শরীরেও আঘাতের চিহ্ন ছিল।
হাইমচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন সুমন বলেন, ঘটনার পর সাতজনেরই ময়নাতদন্তের কাজ চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের নিকট মরদেহ হস্তান্তর হবে। একই সঙ্গে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, নিহত সাতজনের প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের থেকে থানায় মামলা হবে।