মশা মারিতে কামান দাগাইবার প্রবাদ যখন চালু হয় তখন মশাকে বেশ তাচ্ছিল্যই করা হইয়াছিল বলা যায়। বাস্তবিক অর্থে মশা মারিতে কামান তো সামান্য বস্তু, আরো বড় কিছু দিয়া মশাকে দমন করা সম্ভবপর হইলে তাহাও যাচাই করিয়া দেখা হইত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রহিয়াছে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। প্রাণহানির পাশাপাশি মশাবাহিত রোগের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয় অপরিমেয়। মশা কতটা অস্বস্তিতে ফেলিতে পারে, তাহা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষ বুঝিতে পারেন অস্থিমজ্জায়। গত বত্সর ইহা সবচাইতে ভালো বুঝাইয়াছে মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া নামের হাড় মুড়মুড়ে রোগটি। মশাবাহিত অনেক রোগের মধ্যে রাজধানীবাসী সবচাইতে বেশি নাজেহাল হইয়াছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায়। স্মরণ করা যাইতে পারে, এই উভয় রোগের বাহক এডিস প্রজাতির মশা। এইবার যাহাতে মশাবাহিত রোগ মহামারির আকার ধারণ করিতে না পারে, তাহার বিবিধ উদ্যোগ দেখা যাইতেছে সিটি করপোরেশনের তরফ হইতে।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলিয়াছেন, রাজধানীর দক্ষিণ অংশে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাইয়া তিনি গিনেজ বুকে নাম তুলিতে চাহেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শনিবার রাজধানীর দক্ষিণ অংশে শুরু হইয়াছে ‘স্বচ্ছ ঢাকা কর্মসূচি’ নামে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান, যাহা চলিবে সপ্তাহব্যাপী। মেয়র মনে করেন, চিকুনগুনিয়া লইয়া সিটি করপোরেশন এইবার সদাসতর্ক। সবচাইতে তাত্পর্যপূর্ণ কথা হইল, এইবার বাসাবাড়িতে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্রের সন্ধান মিলিলে ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাসাবাড়ি বা বাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত টায়ার বা কনটেইনারে স্বচ্ছ পানি জমিয়া থাকিলে তাহা পরিচ্ছন্ন রাখিতে সংবাদমাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি ১ লক্ষ ৬৫ হাজার বাসাবাড়িতে সচেতনতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করিতেছে ডিএনসিসি। উদ্দেশ্য অতীব উত্তম, সন্দেহ নাই। যাহারা রাজধানীর বুকে মূল্যবান বাড়ির মালিক, তাহারা মশক নিধনে ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিবেন না, ইহা নিঃসন্দেহে সুনাগরিকসুলভ আচরণ নহে। কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে, জেল-জুলুম-জরিমানার ভয় দেখাইয়া স্বচ্ছ ঢাকা কার্যক্রমকে টেকসই করা যাইবে না। ইহার জন্য প্রয়োজন বত্সরব্যাপী সিটি করপোরেশনের কার্যকর বিবিধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা।
বস্তুত, স্বচ্ছ-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকিবার বিষয়টি অভ্যাসগত। ইহা যাহাদের অভ্যাসে নাই, তাহাদের ভয় দেখাইয়া দুই দিনের জন্য ‘লাইনে’ আনা যাইতে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ তৈরি করা সম্ভব নহে। কেবল ভয়ভীতি বা হুমকি-ধামকি নহে, মশক নিধনে কিংবা টেকসই স্বচ্ছ ঢাকার জন্য নিরন্তর নিষ্ঠার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে সিটি করপোরেশনকেই। কারণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন জায়গাসমূহেই সবচাইতে বেশি দূষণ বা মশার প্রজননক্ষেত্র দেখা যায়। সুতরাং অন্যদের উপর কেবল তর্জন-গর্জন নহে, নিজের কর্তৃত্বাধীন স্থানসমূহের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। ইহার পাশাপাশি রাজধানীবাসীর ভেতরে সুনাগরিকসুলভ দায়দায়িত্ব গড়িয়া তুলিবার ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিবিধ কর্মসূচি চালাইতে হইবে। ইহার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাইবে দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর কর্মসূচির মাধ্যমে, কোনো জাদুর কাঠি দিয়া রাতারাতি সব ঠিক করিয়া ফেলাও সম্ভব নহে।