জেলখানার কয়েদিদের চিঠি বিনিময় নিয়া যুগে যুগে রচিত হইয়াছে অসংখ্য গান ও গল্পগাঁথা। এইসব অধিকাংশ গল্প ও গান বেদনাময়। কালের স্রোতে মানুষের জীবন হইতে চিঠি আজ হারাইয়া যাইতে বসিয়াছে। একই কারণে কয়েদিদের চিঠি বিনিময়ের সেই চলও আর তেমন নাই। এখন মুহূর্তের মধ্যে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর পৌঁছাইয়া যাইতেছে প্রিয়জনদের কাছে। তাই নূতন বত্সরে সরকার উপহার হিসাবে এবং পরীক্ষামূলকভাবে কারাবন্দিদের জন্য প্রথমবারের মতো চালু করিল মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুবিধা। গত বুধবার টাঙ্গাইল কারাগারে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ‘স্বজনদের সঙ্গে সংশোধনের পথে’ এই স্লোগানকে বুকে ধারণকারী এই কার্যক্রমের নামকরণও চমত্কার হইয়াছে—‘স্বজন পরিবারের বন্ধন’। কারাগারে যাহারা বন্দি থাকেন তাহারা আত্মীয়-স্বজনের সহিত দেখা-সাক্ষাত্ করিবার জন্য মরিয়া হইয়া অপেক্ষা করেন, কথা বলিবার জন্য থাকেন উদগ্রিব। কেননা কারাগারে সাধারণত একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতাই তাহাদের সঙ্গী। আধুনিক যুগে কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। সেই হিসাবে তাহাদের সহিত যথাসম্ভব মানবিক আচরণই প্রত্যাশিত। এইজন্য কারাগারে থাকিয়া স্বজনদের সহিত মোবাইলে কথা বলিবার যে নিয়ম চালু হইল, তাহাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আশা করি, ইহাতে সংশোধননীতির প্রতিফলন ঘটিবে এবং পর্যায়ক্রমে দেশের প্রধান কারাগারসহ সব কারাগারে নেওয়া হইবে এই উদ্যোগ।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড ও বাংলাদেশ জেলের সহায়তায় এই কার্যক্রম চালু হইল। ইহার আওতায় বন্দিরা (হাজতি ও কয়েদি) কারাগারে আসিবার পর তাহাদের স্বজনদের দুইটি মুঠোফোন নম্বর রাখা হইবে। মাসে একজন বন্দি দুইবার ১০ মিনিট করিয়া কথা বলিবার সুযোগ লাভ করিবেন। কথা বলিবার ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ ও বন্দিদের সঙ্গে আসা শিশুদের দেওয়া হইবে অগ্রাধিকার। বন্দিদের স্বজনেরা নির্ধারিত সময়ে যাহাতে কথা বলিবার জন্য প্রস্তুত থাকেন, সেইজন্য আগের দিন তাহাদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠাইয়া সময় জানাইয়া দেওয়া হইবে। তবে বন্দিদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনের সদস্য এবং অপহরণ ও চাঁদাবাজির মামলায় অভিযুক্ত বন্দিরা সংগত কারণে এই সুবিধা পাইবে না। প্রকৃতপক্ষে কারাগারে অবৈধ মোবাইলের ব্যবহার চলিয়া আসিতেছে দীর্ঘ দিন ধরিয়া। একশ্রেণির শীর্ষ অপরাধী ইহার মাধ্যমে কারাগারে বসিয়াই বাহিরের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করিতেছিল। অন্যদিকে সাজাপ্রাপ্ত অন্য বন্দিরা তাহাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিবার সুযোগ পাইত না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সুযোগ পাইলেও অনেক ভোগান্তি পোহাইতে হইত।
অতঃপর ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে নূতন কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কয়েকটি অনুশাসন দেন তাহার অন্যতম ছিল বন্দিদের মোবাইল ফোনে কথা বলিবার সুযোগ প্রদান। ইহার আগে ২০১৪ সালে কাশিমপুর কারাগারের অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটিও বৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়টি তাহাদের সুপারিশে উল্লেখ করে। যাহা হউক, নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দিদের প্রতিটি কল রেকর্ডও করা হইবে বলিয়া জানা যায়। ইহাছাড়া টেলিফোন বুথে সার্বক্ষণিক কারারক্ষী নিয়োজিত থাকিবেন। এত নিয়ম-কানুনের পরও টেলিফোনে কিছুটা সময় স্বজনদের দিতে পারা নিঃসন্দেহে একটি বড় বিষয় ও আনন্দঘন মুহূর্ত। ইহার মাধ্যমে বন্দিদের পারিবারিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকিবে বলিয়া প্রত্যাশা করা যায় যাহা সামাজিক উন্নয়নের জন্যই জরুরি।