২০১৭ সালের স্নাতক, অভিনন্দন। যাঁদের সহযোগিতায় এই বিশেষ দিনটি তোমাদের জীবনে এসেছে, শুভেচ্ছা তাঁদেরও। একটা ব্যক্তিগত গল্প বলে আমি আমার কথা শুরু করব।
গত বছর স্টারবাকস কফি প্রথমবারের মতো সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে একটা স্টোর চালু করেছে। এর আগে আমি কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকায় যাইনি। তাই তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না। সেখানকার মানুষের দারিদ্র্য, দুঃখ-দুর্দশা দেখার মতো কোনো প্রস্তুতিও আমার ছিল না।
আমরা সেখানে দুটো দোকান চালু করেছি। এর আগে আমি ৫০ জন তরুণের সঙ্গে বসেছিলাম, যারা সবুজ অ্যাপ্রোন পরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করবে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আমি এই তরুণদের প্রত্যেকের গল্প শুনেছি।
তারা যখন বলতে শুরু করল, দেখলাম দারিদ্র্য, সংগ্রাম ছাড়াও মানুষগুলোর জীবনে অনেক আনন্দ আছে। এই আনন্দের জন্য তাদের হৃদয় ভরে আছে কৃতজ্ঞতায়। তবে তাদের কাছ থেকে আমি দুটো জিনিস জানলাম। প্রথমত, এই ৫০ তরুণের কেউই আগে কখনো কোনো চাকরি করেনি। প্রথম চাকরিতে ঢুকতে যাচ্ছে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভীষণ রোমাঞ্চ কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, তাদের কাছে একটা আফ্রিকান শব্দ শিখলাম। এই শব্দটা নেলসন ম্যান্ডেলাও তাঁর বক্তৃতায় বারবার ব্যবহার করেন। শব্দটা হলো, ‘উবুন্টু’। জানতে চাইলাম, এর অর্থ কী?
উবুন্টু অর্থ হলো, ‘তোমার জন্যই আমি এখানে’। প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আজ এখানে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য যেহেতু আমার হয়েছে, আমি বলব, এই ঘটনাটা মনে রেখো। কারণ উবুন্টুর আলোকেই আজ তোমাদের সঙ্গে কথা বলব।
নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে আমার বেড়ে ওঠা। মা-বাবা দুজনের কেউই হাইস্কুল পেরোতে পারেননি। ভাই, বোন, মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের দুই রুমের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, ভাড়া মাত্র ৯৬ ডলার। সেটা দেওয়াও মা-বাবার জন্য সহজ ছিল না। সাত বছর বয়সে আমার জীবনে একটা কঠিন সময় এল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাবা সোফায় শুয়ে আছেন। তাঁর কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত প্লাস্টার করা। যেহেতু হাইস্কুল ড্রপআউট ছিলেন, বাবা কখনোই খুব ভালো কাজ পাননি। জীবনের অনেকটা সময় শ্রমিকের কাজ করেছেন। কিন্তু ১৯৬০ সালে তিনি যে চাকরিটা করতেন, সেটা ছিল সবচেয়ে বাজে। বাবার কাজ ছিল ট্রাকে করে কাপড়ের ডায়াপার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। সে সময়ের নিয়ম ছিল, তুমি যদি একজন অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক হও, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তোমার চাকরি যাবে। শ্রমিকদের জন্য কোনো স্বাস্থ্যবিমা ছিল না, ছিল না কোনো ক্ষতিপূরণ। অতএব সাত বছর বয়সেই আমি আমার মা-বাবার চোখে প্রবল শঙ্কা দেখে ফেললাম। তাঁদের চোখে স্বপ্নভঙ্গের ভয় দেখলাম। সেই ব্যথা, লজ্জা এখনো আমার মনে পড়ে।
ছেলেবেলায় কখনো কল্পনাও করিনি, একদিন আমার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান হবে। ৭৫টি দেশে সেই প্রতিষ্ঠানের ২৬ হাজার স্টোর থাকবে, ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে! প্রথম দিন থেকেই আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, এমন একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাব যেমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ আমার বাবা কখনো পাননি। যে প্রতিষ্ঠান মানুষ ও মানুষের কাজের মূল্যায়ন করবে, কর্মীদের সম্মান জানাবে। সে জন্যই আমাদের কর্মীদের জন্য আছে ৩০ বছরের স্বাস্থ্যবিমা। প্রতিষ্ঠানের মালিকানার একটা অংশও তাঁদের, তাঁরা লভ্যাংশ থেকে ভাগ পান। এমনকি যাঁরা খণ্ডকালীন চাকরি করেন, তাঁরাও পান। আমি বিশ্বাস করি, জীবন ও ব্যবসায় সফলতা আসবে তখনই, যখন আমরা ভাগাভাগি করে নিতে শিখব।
আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। আশা আরও বাড়ে, যখন তোমাদের দিকে তাকাই। কারণ, আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তু এ সময়ের ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ, কারও হাতেই নেই। ভবিষ্যৎ এখন তোমাদের হাতে। তোমাদের জীবনে সাফল্যের সঙ্গে হয়তো অনেক দুর্ভাবনাও আসবে। ভেবো না। কাল কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু সময়ই দিতে পারবে।
একদিন আমিও একরাশ দ্বিধা নিয়ে তোমাদের মতো সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বসে ছিলাম। আমি বলব, সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাস রেখো। আর তিনটা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভেবো। কীভাবে মা-বাবা ও পরিবারকে সম্মান জানাবে? কীভাবে সম্মানের সঙ্গে নিজের সফলতা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে? কীভাবে নম্রতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেবে এবং নৈতিক শক্তি প্রদর্শন করবে? পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই তোমরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাচ্ছ। শুধু ক্লাসরুমে যা শিখেছ, তার ওপর নির্ভর করে থেকো না। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা, যোগ্যতা সবই তোমাদের আছে। তোমার সহমর্মিতা, কৌতূহল, অন্যের জন্য কিছু করার অঙ্গীকার, সাহস, সবকিছুকে পুঁজি করে ঝাঁপিয়ে পড়ো। যা পেয়েছ, তার চেয়ে বেশি দাও। আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার দান আরও হাজার গুণে তোমার কাছেই ফিরে আসবে।
আজ তোমরা যে এখানে বসে আছ, ভেবে দেখো, এর পেছনে কারও না কারও অবদান আছে। মা-বাবা, ভাইবোন, শিক্ষক, প্রতিবেশী, পরামর্শদাতা—কেউ না কেউ তোমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল। কেউ না কেউ তোমার স্বপ্নটাকে ডালপালা মেলতে সাহায্য করেছে। আজ এই প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটু সময় নিয়ে তাঁদের কথা ভাবো। তাঁরা যদি এখানে উপস্থিত থাকেন, তাঁদের আলিঙ্গন করো। এই অভাবনীয় সহযোগিতা ও ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ জানাও।
তোমাদের প্রজন্ম যেভাবে মানুষে মানুষে বন্ধন তৈরি করতে পারে, সেটা আর কেউ কখনো পারেনি। তোমাদের আছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা, নেতৃত্বের গুণাবলি। তোমরা আমাদের অর্থনীতিকে বদলে দেবে, লাখ লাখ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে। তোমাদের কল্যাণেই একদিন বর্ণবাদ শুধু ইতিহাসের বইতেই থাকবে। হ্যাঁ, তোমরা পারবে। তোমরাই আমাদের শেখাবে, মানুষ তার সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে পৌঁছাতে পারে তখনই, যখন সে অন্যকে সম্মান করে, উদ্যাপন করে, ব্যতিক্রমকে স্বাগত জানায়।
এএসইউ (অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি) আজ তোমাদের জন্যই। তোমরা আজ এএসইউয়ের জন্যই। আমরা আজ একে অপরের জন্য। তাই আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলো, উবুন্টু! উবুন্টু! উবুন্টু!
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: স্পিকোলা ডট কম