‘আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, বাবার মতো’— ছোটবেলার সেই চিত্কার এখনো আমার কানে ভাসে, আর সবাই বলছে মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে না। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তো পড়েছি, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং আর করা হয়নি, বলছিলেন সোনিয়া আক্তার। তার কথায় পরে আসছি। আসলেই পড়ার বিষয় হিসেবে অনেক বিষয়ই আমাদের পছন্দ হয় কিন্তু সেটি পেশা হিসেবে ততটা পছন্দসই হয় না। ডাক্তার, আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন এসব বিষয়ে নারীরা পড়ে, কিন্তু দেখা যায় পরবর্তীকালে পেশা হিসেবে সেটির চর্চা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ডাক্তারি পড়ার জন্য নারীদের আগ্রহ অনেক বেশি থাকে। কিন্তু একজন নারীকে ডাক্তারি চর্চা চালিয়ে যেতে গেলে অপারেশন থিয়েটার, রোগী দেখা নিয়ে অনেক সময় দিতে হয়। অনেকসময় মাঝরাতে ডিউটি করতে হয়, নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। একজন নারীর পক্ষে ঘর-সংসার সামলিয়ে পেশাগত কাজে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে।
মারিয়া আক্তার বলেন, অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে ডাক্তার হতে বেশি সময় লাগে। আমাদের দেশে ডাক্তার হওয়ার জন্য আগ্রহীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই প্রাইভেট বা সরকারি মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পাওয়া খুবই কঠিন। বহু পরীক্ষার্থীর মাঝে আমি সত্যি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম যে ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজে আমার পড়ার সুযোগ হয়। ছয় বছর ডাক্তারি করার অনেক স্বপ্ন নিয়ে এটি পড়া। কিন্তু পাস করার পরপর আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার স্বামী একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন যে, তিনি ব্যবসা করলে আমার ডাক্তারি করার দরকার নেই। আমি তবু কিছুদিন একটি হাসপাতালে ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করি। ফিরতে ফিরতে আমার দেরি হতো। অনেক সময় হাসপাতালে রাতে ডিউটি করতে হতো। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ি সেটি মেনে নেয়নি। সন্তান হওয়ার পর আমার ডাক্তারি সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিতে হয়।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সোনিয়া আক্তার বলেন, আমি বাসায় মোটামুটি সংগ্রাম করেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। আমি আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের মাঠে-ঘাটে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। যেখানে বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে যেতে হয়। এভাবে সারা বছর ধরে সারা দেশই ঘুরে বেড়াতে হয়। একজন নারীর জন্য ঘর-সংসার রেখে এ ধরনের কাজ করা একটু কঠিন। আমার স্বামী ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়েছেন। তিনি আমাকে কাজের ক্ষেত্রে উত্সাহই দিতেন। তার উত্সাহে আমি একটি ফার্মে যোগ দেই। কিছুদিন কাজও করি। কিন্তু সেসময় তিনি পিএইচডির অফার পান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি চলে গেলে আমি ও আমাদের একমাত্র সন্তানই দেশে রয়ে যাবে, যেটি অনেক কঠিন হবে আমাদের জন্য। আবার আমার চাকরির কারণে এমন বড় একটি সুযোগ তার জন্য ছাড়া কঠিন। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চাকরি ছেড়ে আমার আমেরিকা চলে আসতে হয়। চার বছর ধরে আমরা আমেরিকায় আছি। অনেক সময়ই স্বামীর ক্যারিয়ারের জন্য একজন স্ত্রীর স্বপ্নের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়। তবে একজন স্ত্রীর জন্য কখনই একজন স্বামী তার ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয় না। এসব কারণে শখ নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও সফল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ারের স্বপ্নটি অপূর্ণই রয়ে গেছে।
আমাদের দেশে নারীর জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত স্বামী, পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। তাই চাইলে এখনো একজন নারী অনেক পেশাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারে না। পরিবার, সংসারের কথা চিন্তা করে ছাড় দিতে হয়। যে ছাড় একপাক্ষিক। পরিবার ও স্বামীর সহযোগিতাই পারে একজন নারীর সব ধরনের পেশায় উন্নত ক্যারিয়ারের স্বপ্নকে পূরণ করতে।