• রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫ অপরাহ্ন

সুরের পাঠশালা

আপডেটঃ : শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭

‘সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা অপরিহার্য’—স্লোগানে পথচলা শুরু করে বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র। ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি পাড়ি দিলো প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর। শুধু কণ্ঠে নয়, বাদ্যে শুদ্ধ সুর-মূর্ছনায় অসুর তাড়াতে একঝাঁক নবীন-প্রবীণ শিল্পী যে লক্ষ্য নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, বলা যায় তাতে তারা অনেকখানি সফল। শুদ্ধ সংস্কৃতিকে মানুষের মর্মে পৌঁছে দিতে নিরন্তর নানা আয়োজন করে চলছেন তারা।

 

বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রকে নিয়ে শোনা যাক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও অধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফা খানের মুখে—

 

‘আকাশ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আজ এক চ্যালেঞ্জের মুখে। এ ব্যাপারে কিছু শিল্পী যেমন  দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায় রয়েছে কিছু চ্যানেলের। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। একটি জাতির পরিচয় পাওয়া যায় তার সংস্কৃতিতে। সংস্কৃতি জাতির ধারক ও বাহক। শিক্ষাঙ্গনে এই সংস্কৃতি চর্চা বেশ গুরুত্ব বহন করে। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই, তবে দেখতে পাবো দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি চর্চা হতো। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। সারাবছরই নানারকম অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। এসব শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা মননশীলতা গঠনে বড় ভূমিকা পালন করতো। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষাঙ্গনেও বেশ সাড়ম্বরে এসব অনুষ্ঠান পালন করা হতো। পুঁথিপাঠ, আবৃত্তি, সঙ্গীত, নাটক, অভিনয় ইত্যাদি নানা ধরনের চর্চা হতো। এসব চর্চায় তাদের সৃজনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পেতো তেমনি তারা শুদ্ধ মনের অধিকারী হতেন। পরবর্তীতে সমাজ গঠনে তারা গঠনমূলক অংশ নিতেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা কী দেখছি? শিক্ষাঙ্গনে সংস্কৃতি চর্চার সেই ঐতিহ্য কী আছে? খুব সহজেই বলা যায়, মোটেই নেই। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য সুখকর নয় এবং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বেণুকার ললিতকলা কাজ করে যাচ্ছে গত ৩৭ বছর ধরে।

 

এর শুরু হয় ১৯৮০ সালে। তবে তার আগে একটা কথা বলতেই হয়, ১৯৭০-এর আগের সময়টাতেও মেয়ে বা ছেলে নৃত্যশিল্পীকে সামাজিক বাঁধা বিপত্তিসহ নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তার মধ্যেও আগ্রহী হিসেবে রওশন জামিল, রাহিজা খান ঝুনু, লায়লা হাসান, লুবনা মারিয়ামসহ বেশ কয়েকজন নৃত্যাভিনয় করেছেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নৃত্যশিল্পের তেমন কোনো প্রচার প্রসারিত হয়নি। ১৯৮০ থেকে ধীরে ধীরে নৃত্যসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রসার লাভ করে। এ সময় শামীম আরা নীপা, দীপা খোন্দকারসহ অনেকেই প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। সেসময় বেশকিছু ছেলেমেয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যায় এবং পরে তারা দেশে এলে প্রসার আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। সেসময় কথক, মণিপুরী নৃত্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা পায়। তবে তখনও দেশে সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব ছিল। সেই অভাবের তাড়না থেকে আমরা বেশ কয়েকজন মিলে গড়ে তুলি বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র।’

 

কথায় কথায় জানা গেল, প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী খালিদ হোসেন সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হয়ে কাজ শুরু করেন। উদ্বোধনের পরপরই কিছু সামাজিক সমস্যার কারণে লালমাটিয়া থেকে বেণুকার কার্যক্রম স্থগিত করে মৌচাক এলাকায় শুধুমাত্র নৃত্যকলা শাখার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ শিরোনামে পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত ও নৃত্যকলা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পরবর্তীতে জায়গার অভাবে ১৯৮৮ সাল থেকে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনে বড় পরিসরে প্রতিষ্ঠানটির নিয়মিত কর্মকাণ্ড শুরু হয়।

 

প্রতিষ্ঠানটি প্রসঙ্গে নজরুলসঙ্গীতশিল্পী লীনা তাপসী খান বলেন, ‘১৯৮৯ সাল থেকে বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রে সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছি আমি। যতদিন ধরে এখানে আছি বেণুকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন, যথেষ্ট পরিশ্রম ছাড়া সহজে অনেকে শিল্পী হতে চায়। তাদের বাবা-মাও চায় যে অল্পদিনে সন্তানের মুখ টিভিতে দেখতে। তখন তারা সেভাবেই গড়ে ওঠে। অকালেই ঝরে যায়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি মানসম্মত শিক্ষাটা দিয়ে গড়ে তুলতে। আমরা অনেককেই সেভাবে গড়ে তুলতে পেরেছি।’

 

এই সঙ্গীতশিল্পী জানালেন আমাদের নতুন প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক শিক্ষা না দিতে পারলে সেটা দেশের জন্য সুখকর হবে না। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে সংস্কৃতি চর্চা এখন এক রকম উঠেই গেছে বলা যায়। এসব চর্চার অভাবে উদীয়মান তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের ভয়াল থাবা তাদের গ্রাস করছে। তারা বিষণ্নতায় ভুগছে। মোবাইল আর ফেসবুকে সময় কাটছে। স্মার্টফোনের মাদকতায় তারা বুঁদ হয়ে আছে। এসবের মধ্যে নেই কোনো সৃজনশীলতা। তাদের সামনে কার্যকর আদর্শ নেই। তরুণরা নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তারা বিপথগামী হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের জঙ্গিবাদ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। পরিবার, সমাজ আর দেশ কোনোকিছুরই তারা তোয়াক্কা করছে না। বিপথগামী এসব তরুণ-যুবাদের ফেরাতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম চালাতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালু করতে হবে। গল্প বলা, কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত, অভিনয়, নাটক, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। সাহিত্য পত্রিকা, দেয়ালিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে এবং সৃজনশীলতার উন্মেষে শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে হবে। ক্লাস রুটিনের সঙ্গে সহপাঠ্য কার্যক্রম সমন্বিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ