পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের কেন্দুয়াই গ্রামের হাবিলদার মো. সোলায়মান মিয়া (৬৪)।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে নিজ বাড়িতে মায়ের কোলে ফেরেন তিনি। তাকে দেখতে ভিড় জমান আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীসহ বন্ধু-বান্ধবরা।
হাবিলদার মো. সোলায়মান মিয়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের কেন্দুয়াই গ্রামের মৃত ফজলুল হক সরদারের ছেলে। তবে বাড়ি ফিরে মাকে পেলেও হারিয়েছেন বাবাকে। এ সময় বাবাকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলে। টানা ১৬ বছর কারাবন্দি জীবনে জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি, শেষ বারের মত বাবাকে দেখতে পারিনি, বাবার কবরে একমুঠো মাটিও দিতে পারিনি, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে আর নেই। এই দীর্ঘ বন্দি জীবনে আপন তিন চাচা কে, দুই মামা ও দুই মামিকে এবং তিন চাচাতো ভাইকে হারিয়েছি, এই কষ্ট কোথায় রাখবো। কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া হাবিলদার মো. সোলায়মান মিয়া।
তিনি জানান, ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে বিডিআর এর চাকরিতে যোগদেন তিনি। চাকরি জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিলো তার। সেই স্বপ্নকে আর বাস্তবে রুপ দিতে পারেননি। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার সময় পিলখানা সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ জেলে যেতে হয় সোলায়মান কে। একই বছরের আগস্টে বাবা ফজলুল হক সরদার মারা যান। বাবা মারা যাওয়া দেড় মাস পর খবর পায় সোলায়মান।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়া আরও বলেন, ২০১৩ সালের নভেম্বরের ৫ তারিখ বিডিআর হত্যা মামলায় আমি খালাস পাই। পরে বিস্ফোরক মামলায় আমাদের আটক দেখানো হয়। পিলখানার ঘটনার দিন আমি ভিতরে ডিউটিরত ছিলাম। পিলখানার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি বিন্দুমাত্র জড়িত নয়। সেই সময় আমি নিজের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলাম।
বিনা অপরাধে আমাকে দীর্ঘ ১৬ বছর কাটাতে হয়েছে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এই বিচার কার কাছে দিব। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকাই বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পারি দেড় মাস পরে। জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি, শেষ বারের মত বাবাকে দেখতে পারিনি, বাবার কবরে একমুঠো মাটিও দিতে পারিনি, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে আর কি হতে পারে। এই দীর্ঘ বন্দী জীবনে আপন তিন চাচা কে, দুই মামা ও দুই মামিকে এবং তিন চাচাতো ভাইকে হারিয়েছি।
আমি চাই যারা অপরাধী, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তাদের বিচার হোক। আমিও যদি দোষী হলে আমারও বিচার হোক। এখনো যারা বিনা দোষে কারাবন্দি আছে তাদের মুক্তি দেয়া হোক। দীর্ঘ ১৬ বছর কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়ায় তিনি আন্দোলনে থাকা ছাত্র-জনতা ও বর্তমান সরকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এবং হারানো চাকরি ফিরে পাওয়া ও পুনর্বাসনে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী কোহিনুর বেগম বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। টাকার অভাবে ঠিকমত স্বামীকেও দেখতে যেতে পারি নাই। অন্যের কাছ থেকে ধার দেনা করে সংসার চলেছে। সংসারে আমার স্বামী ছাড়া উপার্জন করার মত কেউ ছিলো না। ১৬ বছর আমি কি যে এক অন্ধকার জীবন পাড়ি দিয়েছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। আজ স্বামীকে মুক্ত হতে দেখে অনেক খুশি আমি।
সুলাইমানের ছোট ভাই ইসমাইল সরদার জানান, দীর্ঘ ১৬ বছর পর বর্তমান সরকারের মাধ্যমে আমার ভাই বাড়িতে এসেছে এতে আমরা অনেক খুশি। তবে কষ্টের বিষয় হলো বাবার বড় ছেলে হয়েও আমার ভাই বাবার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি এবং শেষ বেলায় কবরে একমুঠো মাটিও দিতে পারেননি। বর্তমান সরকারের কাছে আমি দাবী জানাই উনার চাকরি জীবনের প্রাপ্যটুকু যেন তিন বুঝে পান।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা জুলেখা খাতুন ছেলেকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি। তিনি বলেন, নামাজের চাটিতে বসে ছেলের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। ছেলেকে জীবন দশায় দেখতে পারবো জীবনেও ভাবি নাই। আজ আমি অনেক খুশি, আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে এসেছে।